রাজ্যে ২৫,৭৫২ বাতিল পদে নতুন নিয়োগ পরীক্ষার ঘোষণা!

SSC Scam Fallout: পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন (WBSSC) শুক্রবার ঘোষণা করেছে যে, তারা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে চলবে এবং ২০১৬ সালের বাতিল হওয়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায়…

WBSSC Upper Primary Counseling: Counseling for Upper Primary to Begin Before the Puja as Scheduled

SSC Scam Fallout: পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন (WBSSC) শুক্রবার ঘোষণা করেছে যে, তারা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে চলবে এবং ২০১৬ সালের বাতিল হওয়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া সমস্ত শিক্ষক ও অশিক্ষক প্রার্থীদের জন্য শীঘ্রই নতুন পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু করবে। সুপ্রিম কোর্ট বৃহস্পতিবার রাজ্য পরিচালিত এবং রাজ্য-সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক ও কর্মীর নিয়োগ বাতিল করার পর এই সিদ্ধান্ত এসেছে।

   

ডব্লিউবিএসএসসি-র চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের আলোকে কমিশন এখন আইনি পরামর্শ নেবে। এই পরামর্শের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে কোন কোন প্রার্থী নতুন পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। তিনি বলেন, “২০১৬ সালে প্রায় ২৬ লক্ষ প্রার্থী পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন এবং প্রায় ২২ লক্ষ প্রার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১.৪১ লক্ষ প্রার্থী নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক পদের জন্য এবং প্রায় ১.৫ লক্ষ প্রার্থী একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক পদের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন।”

সুপ্রিম কোর্টের রায় ও এর প্রভাব

বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে “দূষিত এবং জালিয়াতি দ্বারা কলঙ্কিত” বলে ঘোষণা করে সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল করেছে। আদালত জানিয়েছে, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম এবং জালিয়াতি হয়েছে, যার ফলে প্রায় ২৬,০০০ চাকরি বাতিল করা হয়েছে। তবে, আদালত এও নির্দেশ দিয়েছে যে, বাতিল হওয়া কর্মীদের পূর্বে প্রাপ্ত বেতন ফেরত দিতে হবে না। এছাড়া, রাজ্য সরকারকে তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।

এই রায় গত বছর কলকাতা হাইকোর্টের ২২ এপ্রিলের সিদ্ধান্তকে বহাল রেখেছে, যেখানে ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর নিয়োগ বাতিল করা হয়েছিল। হাইকোর্ট উল্লেখ করেছিল যে, ওএমআর শিটে অনিয়ম, র‍্যাঙ্কে কারচুপি এবং প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও নিয়োগের মতো গুরুতর ত্রুটি ছিল। সুপ্রিম কোর্টও বলেছে, মূল ওএমআর শিট এবং উত্তরপত্র হারিয়ে যাওয়ায় যোগ্য এবং অযোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করা সম্ভব হয়নি।

নতুন নিয়োগের প্রস্তুতি

সিদ্ধার্থ মজুমদার জানিয়েছেন, নতুন পরীক্ষার জন্য প্রার্থীদের যোগ্যতা নির্ধারণে আইনি পরামর্শ গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, “আমরা শীঘ্রই এই প্রক্রিয়া শুরু করব। তবে, কারা এই পরীক্ষায় বসতে পারবেন, তা নিয়ে আমাদের স্পষ্ট ধারণা দরকার। ২০১৬ সালে যাঁরা পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের বয়স এখন নিয়োগের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এই বিষয়ে আমরা আইনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।”

তিনি আরও জানান, নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। “আমরা চাই, যোগ্য প্রার্থীরা তাঁদের ন্যায্য সুযোগ পান। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, আমরা তিন মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ করতে বদ্ধপরিকর।” এছাড়া, আদালত বাতিল হওয়া প্যানেলের প্রার্থীদের নতুন পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য বয়সের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কথাও বলেছে, যা অনেকের জন্য স্বস্তির বিষয়।

শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া

এই রায়ের পর শিক্ষক সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যাঁরা ২০১৬ সালে নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। একজন শিক্ষক, রজত হালদার, বলেন, “আমরা যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছিলাম। তদন্তে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবু আমাদের চাকরি গেল। এটা আমাদের প্রতি গুরুতর অন্যায়।” তিনি জানান, আক্রান্ত শিক্ষকরা এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দায়ের করার কথা ভাবছেন।

অন্যদিকে, যাঁরা পরীক্ষা দিয়েও চাকরি পাননি, তাঁরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। একজন চাকরিপ্রার্থী, অভিষেক সেন, বলেন, “আমরা ২০১৯ সাল থেকে রাস্তায় প্রতিবাদ করে আসছি। এই রায় আমাদের জন্য ন্যায়বিচারের আশা জাগিয়েছে। যোগ্যরা এখন সুযোগ পাবেন।”

Advertisements

শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব

এই বাতিলকরণ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক ও কর্মীর চাকরি চলে যাওয়ায় স্কুলগুলোতে শিক্ষকের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, নতুন নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একজন শিক্ষাবিদ বলেন, “এত বড় সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি বাতিল হওয়ায় গ্রামীণ স্কুলগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।”

এছাড়া, রাজ্যে গত কয়েক বছরে সরকারি স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে। শিক্ষা ও সাক্ষরতা বিভাগের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ৩,২৫৪টি স্কুলে একজনও ছাত্র নেই। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক সংকট শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করতে পারে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

এই রায় তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিরোধী দল বিজেপি এই ঘটনাকে “চাকরি কেলেঙ্কারি” বলে সরকারের সমালোচনা করেছে। বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “এটি প্রমাণ করে যে তৃণমূল সরকার যোগ্য প্রার্থীদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।” তবে, তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, “আমরা আদালতের রায়কে সম্মান করি। তবে, নতুন নিয়োগে আমরা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করব।”

ডব্লিউবিএসএসসি জানিয়েছে, তারা শীঘ্রই একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে নতুন পরীক্ষার সময়সূচি ও নির্দেশিকা প্রকাশ করবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে, যাতে ওএমআর শিট হারানো বা কারচুপির মতো সমস্যা না হয়। মজুমদার বলেন, “আমরা একটি নির্ভুল এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে চাই, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি না হয়।”

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বাংলার শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। ২০১৬ সালের বিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়ার অবসান ঘটিয়ে এখন যোগ্য প্রার্থীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে। তবে, এই প্রক্রিয়া কতটা দ্রুত এবং স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়, তা নিয়ে সকলের নজর থাকবে। শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান এখন এই নতুন নিয়োগের ওপর নির্ভর করছে।