বোলপুর: জাতীয় পরিবেশ আদালতের ছাড়পত্র মিললেই বহু প্রতীক্ষিত পৌষমেলা (Poush Mela) আবারও ফেরত আসছে তার নিজের ঐতিহ্য নিয়ে। এ বছর মেলা আয়োজিত হবে শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীর মাঠে, ২৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে চলবে টানা ছয় দিন। মঙ্গলবার বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে উপাচার্য প্রবীরকুমার ঘোষের তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট এবং বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের যৌথ বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইউনেসকোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ স্বীকৃতি পাওয়ার পর এটি দ্বিতীয় পৌষমেলা হওয়ায় স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটকের আগ্রহও তুঙ্গে।
এবারের পৌষমেলায় বেশ কিছু নতুন নিয়ম কার্যকর হতে চলেছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে প্লট বুকিং নিয়ে অনিয়ম ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বভারতী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বুকিংয়ের টাকা জমা দিলেই সঙ্গে সঙ্গে বরাদ্দ করা হবে স্টলের জায়গা। এছাড়া নির্দিষ্ট প্লট চাইলে স্টল মালিককে দিতে হবে নির্ধারিত মূল্যের দ্বিগুণ। বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ আধিকারিক অতীগ ঘোষ জানিয়েছেন, “পৌষমেলার সঙ্গে শান্তিনিকেতনের আবেগ জড়িয়ে আছে। কিন্তু পরিবেশ আদালতের নির্দেশ মানা বাধ্যতামূলক। তাই বুকিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও কঠোরতা দুটোই বজায় রাখা হবে।”
২০১৬ ও ২০১৮ সালে পরিবেশ কর্মী সুভাষ দত্তের দাখিল করা মামলার ভিত্তিতে জাতীয় পরিবেশ আদালত পৌষমেলায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত একাধিক শর্ত জারি করেছিল। সেই সব নির্দেশ এ বছরও কড়াভাবে মানা হবে বলে জানানো হয়েছে। আদালতের ছাড়পত্র পাওয়ার পর বীরভূম জেলা প্রশাসনের সঙ্গে চূড়ান্ত প্রস্তুতি বৈঠক করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষাই থাকবে মূল অগ্রাধিকার।
ইতিহাস অনুযায়ী, পৌষমেলার সূচনা ১৮৪৫ সালে, যখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪৩ সালের ৭ পৌষে ব্রহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সেই দীক্ষার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে শুরু হয়েছিল ব্রহ্ম উপাসনা এবং তার সঙ্গে মেলার আয়োজন। পরে শান্তিনিকেতনে আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর ১৮৯১ সাল থেকে পৌষমেলা নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মহর্ষির নির্দেশ অনুযায়ী এটি সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র এবং এখানে মদ-মাংস বিক্রি, কদর্য আমোদ-উল্লাস ও মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ।
যদিও পৌষমেলার ইতিহাসে কিছু বছরে আয়োজন বন্ধ ছিল। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর, ২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতি এবং ২০২১–২৩ সালে উপাচার্য-রাজ্য সংঘাতের কারণে মেলা বন্ধ থাকে। ২০১৯ সালের পরে প্রথমবার ২০২৪ সালে ফের মেলা আয়োজিত হলে নতুন উদ্যমে ফিরে আসে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য।
এবারও স্থানীয় বাসিন্দা, আশ্রমিক, ছাত্রছাত্রীসহ দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা অপেক্ষা করছেন নতুন বছরের পৌষ প্রভাতের জন্য। বাউলের সুর, হস্তশিল্পের স্টল, নাচ-গান, আশ্রমিকদের অনুষ্ঠান— সব মিলিয়ে শান্তিনিকেতন আবারও ফিরে পাবে তার প্রাণ, তার উৎসবের স্পন্দন। বহু মানুষের আশা, এ বছরের পৌষমেলা বিশ্বভারতীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গির মিলিত উদযাপন হয়ে উঠবে।


