পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরির এক শান্ত গ্রাম। সন্ধ্যা নামতেই আকাশ ভরে ওঠে শঙ্খধ্বনি, ধূপের গন্ধ আর দীপশিখার আলোয়। এ এক ভিন্ন আবহ—কারণ এখানে ১৮৪ বছর ধরে টিকে আছে ঘোষ পরিবারের কালীপূজা। একসময়ের জমিদার পরিবার আজও ধরে রেখেছে তাঁদের ভক্তি, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতার প্রদীপ।
ঐতিহ্যের সূচনা: ১৮৪২ সাল থেকে আজও জ্বলছে প্রদীপ
ঘোষ পরিবারের কালীপূজার সূচনা হয় ১৮৪২ সালে। মূলত হুগলির তিরোল অঞ্চলের জমিদার বংশভুক্ত এই পরিবার পরবর্তীতে খেজুরিতে বসবাস শুরু করে। দেবী কালী আরাধনাকে তাঁরা করেছিলেন পারিবারিক ভক্তির প্রতীক। প্রথম পূজা ছিল সরল—একটি মাটির প্রতিমা, কিছু প্রদীপ, আর পরিবারের নিবেদিত প্রার্থনা। কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয় এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের যাত্রা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আজও টিকে আছে।
রীতি ও প্রস্তুতি: সরলতার মধ্যে রাজসিকতা
জমিদার পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী পূজার প্রস্তুতি হয় রাজসিক শৃঙ্খলায়। বাড়ি সাজানো, পুরনো ঝাড়বাতি পরিষ্কার, আলপনা আঁকা—সবকিছুতেই ঐতিহ্যের ছাপ। প্রতিমা তৈরি করেন স্থানীয় কুমোর পরিবার, যারা নয় প্রজন্ম ধরে ঘোষ পরিবারের জন্যই কালীমূর্তি গড়ছেন। লক্ষ্মীপূজার দিন থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়, আর পূজার দিন সন্ধ্যা নামতেই শত শত প্রদীপের আলোয় আঙিনা ঝলমল করে ওঠে।
ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও ঘোষ পরিবারের পূজা এখনও আগের মতোই ঘরোয়া ও আন্তরিক। তারা কখনও পূজাকে জনসমাগম বা বাণিজ্যিক উৎসবে পরিণত করেননি। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে পরিবর্তন—আলোকসজ্জা আধুনিক হয়েছে, সামগ্রী সংগ্রহ সহজ হয়েছে, কিন্তু পূজার রীতি-নীতি একটুও বদলায়নি।
পরিবার ও সমাজের সংযোগ
অতীতের জমিদার ঐতিহ্য আজ পারিবারিক গর্ব ছাড়িয়ে স্থানীয় সমাজেরও অংশ। গ্রামের মানুষ দূর থেকে প্রদীপের আলো দেখে বলে ওঠেন—“ওটাই ঘোষ বাড়ির পূজা।” পূজার রাত যেন পুরো গ্রামকে এক করে দেয়। পরিবার থেকে শুরু করে প্রতিবেশী সবাই এই পূজাকে মনে করেন ঐক্যের প্রতীক।
উত্তরাধিকার টিকিয়ে রাখার প্রেরণা
আজকের তরুণ প্রজন্মও প্রতি বছর কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষার ব্যস্ততা পেরিয়ে এই পূজার জন্য খেজুরিতে ফিরে আসে। তাঁদের কাছে এটি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং নিজেদের শিকড় ও আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সংযোগের সেতুবন্ধন। ঘোষ পরিবার আশাবাদী, একদিন এই পূজা ২০০ বছরের ঐতিহ্যে পৌঁছাবে, আর তখনও দেবী কালী একই ভক্তি ও নিষ্ঠায় পূজিত হবেন।
খেজুরির ঘোষ পরিবারের ১৮৪ বছরের কালীপূজা বাংলার জমিদার ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক। ঐশ্বর্যের আড়ালে রয়েছে ভক্তির গভীরতা, আর এই ধারাবাহিকতা মনে করিয়ে দেয়—বিশ্বাস, ঐক্য ও পারিবারিক ভক্তিই সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার।


