HomeWest BengalSouth Bengalসুবর্ণরেখা তীরে সূর্যদেবকে নৌকা উৎসর্গ, রাসযাত্রায় অনন্য প্রথা ঝাড়গ্রামে

সুবর্ণরেখা তীরে সূর্যদেবকে নৌকা উৎসর্গ, রাসযাত্রায় অনন্য প্রথা ঝাড়গ্রামে

- Advertisement -

ঝাড়গ্রাম: ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরের সুবর্ণরেখা নদীর তীরে প্রতিবছর রাসযাত্রার (Jhargram Ras Yatra) সময় দেখা যায় এক অপূর্ব দৃশ্য সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে রঙিন শোলার নৌকা ভাসাচ্ছেন গ্রামের মানুষ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা এই ঐতিহ্য আজও স্থানীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে।

প্রতিবছর রাসযাত্রার দিনে সকাল থেকেই নদীর তীরে জমায়েত হন গোপীবল্লভপুর, আশুই, ধর্মপুর ও শ্যামসুন্দরপুর গ্রামের বাসিন্দারা। সূর্যদেবকে প্রথম নিবেদন জানিয়ে তাঁরা রাধাকৃষ্ণের রাসপুজোর প্রস্তুতি নেন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীতীরে শুরু হয় নৌকা ভাসানোর অনুষ্ঠান। স্থানীয় নারীরা শোলার নৌকা সাজান বিভিন্ন রঙিন কাগজ, ফুল, তুলসী পাতা, আঁখ, কচু ও হলুদের ডাল দিয়ে। এরপর সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে সেই নৌকাগুলি নদীর বুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

   

গ্রামবাসীদের মতে, এই রীতি শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর এক প্রাচীন প্রয়াস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সুবর্ণরেখা নদীর জল ও সূর্যের আলোতেই এই এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন তাই এই দুই শক্তিকে পূজা করার মাধ্যমে তাঁদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।

নৌকা ভাসানোর আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার পালিত হয়। নদীর ধারে বালির মধ্যে পাঁচ প্রজাতির গাছ আঁখ, কচু, তুলসী, হলুদ ও এক প্রকার দেশি গাছ পুঁতে তাতে নদীর জল ঢেলে পুজো করা হয়। এর পরেই সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে নৌকা নিবেদন শুরু হয়। এই অনুষ্ঠান শেষে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে রাসপুজো হয়, সন্ধ্যায় ভক্তিমূলক গান, কীর্তন ও মেলা বসে।

আশুই গ্রামের বাসিন্দা সনাতন দাস বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা এই রীতি শুরু করেছিলেন সূর্যদেবকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য। আমরা আজও সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। রাসযাত্রার দিন সূর্যদেবকে নৌকা ভাসানো মানে আলোক, শক্তি ও জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ।”

স্থানীয় প্রবীণরা জানান, গোপীবল্লভপুর অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের মিলনস্থল। তাই এখানকার সংস্কৃতিতে তিন রাজ্যের ঐতিহ্যের মেলবন্ধন দেখা যায়। নদীঘেঁষা এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে সূর্য ও জল দেবতার মতোই পূজনীয়। এই প্রথার মাধ্যমে তারা প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক আরও মজবুত করে তোলে।

রাসযাত্রার দিন সকাল থেকেই উৎসবের আবহ ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। পুরুষরা নদীতে নৌকা নামানোর প্রস্তুতি নেন, মহিলারা পুজোর সামগ্রী সাজান, আর শিশুরা পতাকা ও ফুল নিয়ে ছুটে বেড়ায়। সন্ধ্যাবেলায় রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে দীপ জ্বলে, ভক্তরা কীর্তনে মেতে ওঠেন। দিনভর এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন।

সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এই প্রথা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এক সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। প্রত্যেকটি পরিবার এতে অংশগ্রহণ করে, গ্রাম একত্রে এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে। তরুণ প্রজন্মও আজ এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে উৎসাহী, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও জানে তাদের শিকড় কোথায়।

আজ যখন আধুনিকতা অনেক গ্রামীণ রীতিনীতিকে মুছে দিচ্ছে, তখন ঝাড়গ্রামের এই অনন্য নৌকা ভাসানো উৎসব প্রমাণ করছে লোকসংস্কৃতি এখনও জীবন্ত। রাসযাত্রার দিনে সূর্যদেবকে নৌকা উৎসর্গ করে গোপীবল্লভপুরের মানুষ কৃতজ্ঞতা জানায় প্রকৃতির প্রতি, যা বাংলার গ্রামীণ জীবনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

- Advertisement -
এই সংক্রান্ত আরও খবর
- Advertisment -

Most Popular