মিলন পণ্ডা, খেজুরি (পূর্ব মেদিনীপুর): পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরিতে ফের প্রকাশ্যে এল বিজেপির অন্তর্দলীয় কোন্দল। দলীয় প্রধানের অভিযোগেই এবার গ্রেফতার হলেন বিজেপি পরিচালিত পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও দুই নেতা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তীব্র আলোড়ন শুরু হয়েছে জেলাজুড়ে — কেউ বলছেন, “আইনের জয়”, আবার কেউ বলছেন, “দল ভেতর থেকেই ভাঙছে বিজেপি।”
ঘটনাটি ঘটেছে খেজুরি বিধানসভা এলাকার নিচ কশবা গ্রাম পঞ্চায়েতে, যা বিজেপি দখলে থাকা একটি বোর্ড। অভিযোগকারিণী মৌসুমী মণ্ডল, এই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। তাঁর অভিযোগ — পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি উদয় শঙ্কর মাইতি, সহকর্মী সুভাষ মণ্ডল এবং তপন প্রামাণিক পূর্ব আক্রোশবশত তাঁর স্বামীকে মারধর করেন, প্রাণঘাতী হামলা চালান এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হুমকি দেন।
তালপাটি উপকূল থানার পুলিশ রাতেই অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করে। শনিবার তাঁদের কাঁথি আদালতে তোলা হলে বিচারক উদয় শঙ্কর মাইতি ও তপন প্রামাণিককে পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতে, আর সুভাষ মণ্ডলকে জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
🧨 ঘটনার সূত্রপাত: মদের ঠেকে বচসা
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঘটনাটির সূত্রপাত হয় খেজুরি আলিপুর বাজারে একটি মদের দোকানে বচসা ঘিরে। সেই বিরোধই পরে রূপ নেয় সহিংসতায়। অভিযোগকারিণীর স্বামী শুকদেব মণ্ডলের সঙ্গে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির তীব্র বাকবিতণ্ডা শুরু হয়, যা পরে হাতাহাতিতে গড়ায়। এরপর তাঁকে বেধড়ক মারধর করা হয়, এমনকি গুলি চালানোর হুমকিও দেওয়া হয়।
⚖️ তদন্তে নেমেছে পুলিশ
খবর পেয়ে মৌসুমী মণ্ডল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ তৎপরতার সঙ্গে তদন্ত শুরু করেছে। তালপাটি উপকূল থানার ওসি কাজল বর্মণ জানান —
“অভিযোগের ভিত্তিতে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে তাঁদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। প্রমাণ পাওয়া গেলে আরও ধারা যোগ করা হবে।”
🔥 বিজেপি বনাম তৃণমূল — পাল্টা অভিযোগের রাজনীতি
এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক তরজাও শুরু হয়েছে।
খেজুরি ২ ব্লকের তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি সমুদ্ভুব দাস কটাক্ষ করে বলেন,
“নিজেদের দলেই এখন গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। কাটমানি থেকে শুরু করে ক্ষমতার দখল—সব কিছু নিয়েই ঝামেলা। নিজেদের পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানই অভিযোগ করছে তাঁদের নেতাদের বিরুদ্ধে!”
অন্যদিকে, খেজুরি ২ ব্লকের বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি কর্মাধ্যক্ষ পবিত্র দাস বলেন,
“এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিরোধ। রাজনৈতিক রং দেওয়া ঠিক নয়। পুলিশ তদন্ত করুক, সত্য সামনে আসবে।”
🔫 আরেক বিজেপি নেতার গ্রেফতার
এই ঘটনার মাঝেই আরও এক বিজেপি নেতা সূর্যকান্ত দাস গ্রেফতার হয়েছেন আগ্নেয়াস্ত্র ও খুনের চেষ্টার মামলায়। অভিযোগ — খেজুরি আলিপুর বাজারে স্থানীয় বিজেপি কর্মী সৌরভ সরকার-এর উপর প্রাণঘাতী হামলা চালান সূর্যকান্ত দাস ও তাঁর দলবল। আদালত তাঁর জামিন নাকচ করে পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে।
🏛️ পটভূমি: দলে ভাঙন ও পুনরায় প্রত্যাবর্তন
খেজুরি ২ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতি নির্বাচনে প্রথমে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু পরে সভাপতি উদয় শঙ্কর মাইতি ও সদস্য পিপাসা দাস তৃণমূলে যোগ দেন, ফলে বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ যায় তৃণমূলের হাতে। কিছু মাস পর আবার উদয়বাবু বিজেপিতে ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি বিজেপির সদস্য থাকলেও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির পদে বহাল আছেন। দলের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন ও ক্ষমতা দখল নিয়ে এই বিরোধ এখন প্রকাশ্যে এসে পড়েছে।
খেজুরির এই ঘটনার পর স্পষ্ট, বিজেপির অন্তর্দলীয় সংঘাত এখন আর গোপন নয়। দলীয় প্রধানের অভিযোগেই যখন সভাপতি গ্রেফতার হন, তখন রাজনীতির মঞ্চে প্রশ্ন একটাই— “যে দল রাজ্য দখলের স্বপ্ন দেখছে, তার নিজের ঘর কি একতাবদ্ধ?”
