নিজস্ব প্রতিনিধি, পশ্চিম মেদিনীপুর: একটি বন্ধুত্বের সূত্রে শুরু হয়েছিল, আজ তা ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার খরার পুরসভার পানপাড়া (Panpara Kali Puja) এলাকার বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির কালীপুজো এ বছর পা দিল ২১৫ বছরে। গ্রামের মানুষের কাছে এই পুজো শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক সামাজিক ঐক্যের প্রতীকও বটে।
কথিত আছে, প্রায় দুই শতাব্দী আগে, এলাকায় কয়েকজন বন্ধু খেলার ছলে ঠিক করেন কালীপুজো করবেন। প্রথমে একজন প্রতিমা তৈরি করতে উদ্যোগী হন, অন্যজন পুজোর সামগ্রী জোগাড় করেন। সেই থেকেই শুরু মা কালীর আরাধনা। কিন্তু সেই প্রথম পুজোর সময় ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা—একজন ভক্ত স্বপ্নে মা কালীর দর্শন পান। মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী পরদিন পুজোয় শোল মাছ পোড়া ভোগ নিবেদন করা হয়। সেই থেকেই এই রীতি আজও অব্যাহত আছে বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির কালীপুজোয়।
বাড়ির প্রবীণ সদস্যরা জানান, মাটির মা কালীর প্রতিমা গড়া হয় বাড়ির দালানেই। প্রতি বছর দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে দীপজ্বেলে শুরু হয় পূজার আসর। চারপাশে ধূপধুনোর গন্ধ, মন্ত্রোচ্চারণ, আর ভক্তদের সমবেত সঙ্গীত—সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক অনন্য পরিবেশ।
বিশেষ ভোগ হিসেবে মাকে নিবেদন করা হয় পোড়া শোল মাছ। বিশ্বাস করা হয়, এই ভোগেই মায়ের পরম তৃপ্তি মেলে। এছাড়াও পায়েস, ফল, মিষ্টি ও নানা রকম ভোগ নিবেদন করা হয়। তবে শোল মাছ পোড়ার ঐতিহ্য আজও এই পুজোর মূল আকর্ষণ।
পুজোর দিন সকাল থেকে বাড়ির নারী সদস্যরা পূজোর নানা প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকেন। সন্ধ্যায় প্রতিমার সামনে সবাই মিলে মায়ের আরাধনা করেন। পুজোর শেষে নিরঞ্জনের দিন সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন পরিবারের সদস্যরা। হাসি, আনন্দ আর ভক্তির এই মেলবন্ধনই যেন বছরের পর বছর ধরে প্রাণবন্ত করে রেখেছে এই পূজোকে।
স্থানীয়দের মতে, এই পুজো আজ গ্রামজুড়ে উৎসবের আবহ তৈরি করে। পাশের গ্রাম থেকেও বহু মানুষ আসেন মায়ের দর্শনে। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের তরুণ প্রজন্ম এখন পুজোর যাবতীয় দায়িত্ব সামলায়, তবে পুরনো নিয়ম-কানুনে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাড়ির এক তরুণ সদস্য জানালেন, “আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখছি মা কালীর এই পুজো। এটা শুধু পূজা নয়, আমাদের ঐতিহ্য। মা’র আশীর্বাদে এই রীতি যতদিন থাকবে, পুজো ততদিন চলবে।”
দুই শতাব্দীর বেশি পুরনো এই পূজো আজ পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী কালীপুজো হিসেবে পরিচিত। বিশ্বাস, ভক্তি, ও প্রজন্মের উত্তরাধিকারের বন্ধনেই টিকে আছে এই ঐতিহ্য, যেখানে মায়ের তৃপ্তি আজও মেলে পোড়া শোল মাছের ভোগে।