রাজ্যের (West Bengal) ষষ্ঠ (Sixth) অর্থ কমিশন (Finance Commission), যা ২০২৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে কার্যক্রম শুরু করবে, এর কাজের মাধ্যমে রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির মধ্যে আর্থিক সঙ্গতি এবং স্বাবলম্বিতা অর্জন করার জন্য একটি সুসংগঠিত রোডম্যাপ তৈরি করতে চায়। এটি শুধুমাত্র রাজস্ব সংগ্রহ (Revenue Collection) বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নয়, বরং স্থানীয় প্রশাসনকে আরো শক্তিশালী, দক্ষ এবং স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করার লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে, অনেক পঞ্চায়েত এবং পুরসভা রাজ্য সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যার ফলে তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং স্বতন্ত্রতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। অর্থ কমিশন এই ব্যবস্থাকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে এবং পঞ্চায়েত, পুরসভাগুলির রাজস্ব সংগ্রহ এবং ব্যয় ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে সুপারিশ করবে।
রাজস্ব সংগ্রহের সুপারিশ:
বর্তমানে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন উৎস থেকে রাজস্ব আদায় (Revenue Collection) হয়ে থাকে, তবে অনেক ক্ষেত্রে এই আদায় যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয় না বা এর সঠিক ব্যবহার মনিটর করা হয় না। অর্থ কমিশন (Finance Commission)এই বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করবে। প্রথমত, পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির জন্য নতুন রাজস্ব সংগ্রহের উপায় তৈরি করা হবে। কমিশন তাদের সুপারিশে বলবে, কীভাবে স্থানীয়ভাবে কর ও ট্যাক্স আদায় বাড়ানো যেতে পারে এবং কোন সেক্টরে এই সংগ্রহে পরিপূরক ব্যবস্থা গড়া সম্ভব। কমিশন পঞ্চায়েতগুলিকে এমন কর ব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করবে, যা তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নত করতে সহায়তা করবে। এতে করে পঞ্চায়েত বা পুরসভাগুলি রাজ্য সরকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, নিজেদের রাজস্ব আয় থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে।
তাছাড়া, যেসব পণ্য বা পরিষেবা থেকে পঞ্চায়েত বা পুরসভাগুলি টোল বা লেভি আদায় করে, সেগুলির পরিমাণ এবং সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন করা হবে। কমিশন এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে এবং সুপারিশ করবে যে, কোন কোন খাতে নতুন রাজস্ব উৎস তৈরির সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে, পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির জন্য প্রযোজ্য এমন সম্ভাব্য নতুন ট্যাক্স বা ফি সিস্টেম প্রস্তাব করা হতে পারে যা সরকারের কাছ থেকে তহবিল ছাড়াই স্বনির্ভর করতে সহায়তা করবে।
সরকারি অনুদান এবং পর্যালোচনা:
রাজ্য সরকারের কনসলিডেটেড ফান্ড থেকে পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলিকে বার্ষিক আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, যাতে তারা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ, যেমন রাস্তা নির্মাণ, নিকাশি ব্যবস্থা উন্নয়ন, পুকুর সংস্কার এবং খাল খননের কাজ পরিচালনা করতে পারে। অর্থ কমিশন এখানে একটি কার্যকরী পদ্ধতি তৈরির জন্য কাজ করবে, যাতে অর্থের সঠিক ব্যবহার এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের মধ্যে স্বচ্ছতা আনা যায়।
কমিশন এমন এক নীতিমালা তৈরি করবে, যার মাধ্যমে সরকার এই আর্থিক অনুদান প্রদান করবে, কিন্তু সেই অনুদান যেন অপব্যয় না হয় এবং সঠিকভাবে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে শুধু পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলির উন্নয়ন হবে না, বরং রাজ্য সরকারের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও শক্তিশালী হবে।
রাজস্ব বণ্টন এবং পঞ্চায়েত-পুরসভার সহযোগিতা:
রাজ্য সরকার এবং পঞ্চায়েত-পুরসভার মধ্যে সুষ্ঠু রাজস্ব বণ্টন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে, রাজ্য সরকারের একক ক্ষমতা থেকে পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির মধ্যে অর্থের বণ্টন হয়ে থাকে। তবে, এই ব্যবস্থায় অনেক সময় দুর্বলতা দেখা দেয়, যার কারণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটে। কমিশন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলির আর্থিক বণ্টন পদ্ধতি পর্যালোচনা করবে এবং সুপারিশ করবে যে, কীভাবে এই বণ্টন ব্যবস্থা আরও দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য করা যায়।
এছাড়া, কমিশন রাজ্য সরকারের প্রতি পরামর্শ দিবে যে, পঞ্চায়েত-পুরসভাগুলিকে আরও বেশি ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া উচিত যাতে তারা নিজেদের আয়ের উৎসগুলো আরও কার্যকরীভাবে ব্যবহার করতে পারে। এই ব্যবস্থায়, পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির মধ্যে আরও বেশি অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আসবে এবং তারা কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে, নিজেদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
কাজের দ্রুত বাস্তবায়ন এবং প্রাথমিক রিপোর্ট:
কমিশন তার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম ছয় মাসের মধ্যে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দেবে, যার মাধ্যমে পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন (evaluation) করা হবে এবং কীভাবে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা সম্ভব, তার একটি রূপরেখা দেওয়া হবে। এই প্রাথমিক রিপোর্টের মাধ্যমে সরকার বুঝতে পারবে, কীভাবে রাজ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও সুশৃঙ্খল এবং শক্তিশালী করা যেতে পারে।
রাজ্যের ষষ্ঠ অর্থ কমিশনের (Finance Commission) কার্যক্রম শুধুমাত্র পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলির আর্থিক স্বাবলম্বিতার লক্ষ্য নয়, বরং একটি বৃহত্তর প্রশাসনিক কাঠামোর অংশ হিসেবে রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে কাজ করবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাগুলির মধ্যে অধিক স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং স্বনির্ভরতা আসবে, যা সামগ্রিকভাবে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই, রাজ্য সরকার এবং পঞ্চায়েত-পুরসভার জন্য এটি একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে, যেখানে তারা তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত করতে সক্ষম হবে।