আবারও শিরোনামে সন্দেশখালি (Sandeshkhali)। আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে। রেশন দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের বহিষ্কৃত নেতা শেখ শাহজাহানের সঙ্গে এবার নতুন করে উঠে আসছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি—শেখ শাহাজাহানের সক্রিয় সহায়তায় গত কয়েক বছরে একাধিক বাংলাদেশি পরিবার সন্দেশখালির বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করে নথিভুক্ত ভারতীয় নাগরিকের পরিচয় পেয়ে সরকারি সুবিধা ভোগ করছে।
এস আই আর (Security Identification and Review) প্রক্রিয়া শুরু হতেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে সন্দেশখালি দু’নম্বর ব্লকের কোড়াকাঠি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৩৫ নম্বর বুথে। এখানেই বহু বছর ধরে নাকি বসবাস করছে একাধিক বাংলাদেশি পরিবার—এমনটাই দাবি স্থানীয়দের। অভিযোগ, এদের অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধভাবে ভারতে এসে প্রথমে আশ্রয় নেয়, তারপর স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা শেখ শাহাজাহানের সহায়তায় এদেশের বিভিন্ন সরকারি নথি সংগ্রহ করে।
‘শাহাজাহানের সাহায্যেই নথি তৈরি’—দাবি স্থানীয়দের
গ্রামের বাসিন্দাদের বক্তব্য, অনুপ্রবেশকারীরা প্রথমে রেশন কার্ড, খাদ্য সুরক্ষা কার্ডের মতো নথি সংগ্রহ করে। এরপর আধার, প্যান, এমনকি বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধাও পেতে শুরু করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, “লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা থেকে শুরু করে রেশনের চাল-আটা—সব কিছুই এখন পাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আসা লোকেরা। অথচ গ্রামের বহু গরিব মানুষ ঠিকমতো রেশন পায় না।”
শাহিন গাজী: ‘বাবার’ পরিচয় নিয়ে বিতর্ক
স্থানীয়দের অভিযোগে উঠে আসছে একজনের নাম—শাহিন গাজী। দাবি, তিনি বাংলাদেশি। কিন্তু সরকারি নথিতে তিনি এই এলাকারই স্থায়ী বাসিন্দা জমির গাজীর ছেলে হিসেবে পরিচিত। শাহিন বর্তমানে তামিলনাড়ুতে ফেরিওয়ালার কাজ করেন।
অন্যদিকে, শাহিনের এক আত্মীয় বলে পরিচিত মর্জিনা বিবি—যাকে নিয়ে আরও জটিল অভিযোগ। অভিযোগ, তিনিও বাংলাদেশি; কিন্তু তিনি তাঁর কাকা নূরালী গাজীকে ‘বাবা’ হিসেবে দেখিয়ে নথি তৈরি করেছেন। তবে মর্জিনার দাবি সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি বলেন, “আমি এই এলাকারই মেয়ে। আমার স্বামী বাংলাদেশি, আমি নই।”
স্বামী গফুর মোল্লার স্বীকারোক্তি নতুন প্রশ্ন তোলে
মর্জিনার স্বামী গফুর মোল্লা স্বীকার করেছেন, “আমার বাড়ি বাংলাদেশের পারুলী গরুর হাট এলাকায়। আমি অবৈধভাবে এখানে এসেছিলাম।”
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—তিনি ভোটার কার্ড না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আধার, রেশন কার্ড ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নথি তৈরি করলেন? তাঁর বক্তব্য, “আমি খাদ্য সুরক্ষার চাল আর আটা পাই।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই গফুর মোল্লা ও তাঁর স্ত্রী মর্জিনা বিবি দীর্ঘদিন ধরে সন্দেশখালিতে বসবাস করে নানা সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন। তাঁদের সন্দেহ—এমন আরও বহু পরিবার আছে, যারা একই প্রক্রিয়ায় এদেশের মানুষ সেজেছে।
হাবিবুল শেখ: ‘শ্বশুরকে বাবা সাজানো’ অভিযোগ
অভিযোগ এখানেই শেষ নয়। আরও এক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে উঠে এসেছে হাবিবুল শেখের নাম।
গ্রামবাসীদের দাবি:
- চার বছর আগে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে তিনি সন্দেশখালিতে ঢোকেন।
- শেখ শাহাজাহানের আশ্রয় পান।
- এরপর স্থানীয় বাসিন্দা আমিরুল শেখের মেয়ে আঞ্জুরাকে বিয়ে করেন।
- তারপর ভোটার নথিতে আমিরুলকেই নিজের বাবা দেখিয়ে ভোটার কার্ড তৈরি করেন।
- অভিযোগ, হাবিবুল এখন খাদ্য সুরক্ষার অধীনে রেশনের চাল-আটা পাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
- ২৩৫ নম্বর বুথ জুড়ে নাকি একাধিক বাংলাদেশির বসবাস
স্থানীয়দের দাবি—এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২৩৫ নম্বর বুথের অন্তত বেশ কয়েকটি পরিবার এভাবেই ঢুকে পড়েছে ভারতে। অভিযোগ, “সবই হয়েছে শাহাজাহানের হাত ধরে। তিনি এলাকার ‘রেশন স্যিন্ডিকেট’ চালাতেন। সেই স্রোতে অনুপ্রবেশকারীরাও কাজে লেগেছে।”
রেশন দুর্নীতির তদন্তে ওঠে আসছে নতুন অভিযোগ
রেশন দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পরে ইডির তদন্তে একাধিক অস্বচ্ছ লেনদেন ও নথি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয়দের দাবি, “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের রেশন কার্ড বানিয়ে দেওয়াই ছিল রেশন দুর্নীতির বড় অংশ।”
তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও কোনও সরকারি প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তদন্তকারী সংস্থাও আনুষ্ঠানিকভাবে অনুপ্রবেশকারীদের প্রসঙ্গে কিছু জানায়নি। কিন্তু গ্রামবাসীদের অভিযোগ ও স্বীকারোক্তির দাবি নতুন করে আলোড়ন তুলেছে সন্দেশখালিতে।
সন্দেশখালির পরিস্থিতি আবারও দেখিয়ে দিচ্ছে—রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও সীমান্ত নিরাপত্তা— এই তিনের সংমিশ্রণ কতটা গভীর সমস্যার জন্ম দিতে পারে। তদন্ত এগোলে সামনে আসতে পারে আরও বড় চিত্রও।
