কলকাতা: বছর ঘুরলেই রাজ্যে বিধানসভা ভোট। তার আগেই ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের প্রস্তুতি শেষের ‘অন্তিম ঘণ্টা’ বাজিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিব এবং জেলা নির্বাচন আধিকারিকদের চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ‘কাগজ ঠিকমত না দিতে পারলে খোয়া যাবে নাগরিকত্ব’, এই আতঙ্কে কার্যত রাতের ঘুম উড়েছে রাজ্যের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার মানুষদের। বাংলাদেশ বর্ডার লাগোয়া মুসলিম অধ্যুষিত মালদা, মুর্শিদাবাদ জেলায় স্ট্যাম্প পেপার নিয়ে জন্মের বিলম্বিত শংসাপত্র তুলতে মানুষের ঢল নেমেছে।
এলাকার পৌরসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত, আদালতের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে জন্মের শংসাপত্রের ভুল শুধরানো, ডিজিটাইজড অথবা নতুন বিলম্বিত শংসাপত্রের আবেদন জানাচ্ছেন তাঁরা। এইসব অঞ্চলে শহরের মত জন্মের শংসাপত্র থাকাটা অত স্বাভাবিক না। প্রত্যন্ত এলাকার বরিষ্ঠ মানুষদের অধিকাংশেরই বাড়িতে জন্ম। চাষ আবাদ বা দিনমজুরের কাজ করা দরিদ্র মানুষজন কোনদিন “বার্থ সার্টিফিকেট”-এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি।
তবে বিহারের পরিস্থিতি বর্তমানে তাঁদের আতঙ্কে ফেলেছে। এখন ‘ওই কাগজ’ ছাড়া ভিটেমাটি খুইয়ে দেশছাড়া হওয়ার ভয়ে তাই সরকারি কার্যালয়ে লাইন দিয়েছেন তাঁরা। মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত আমলাই গ্রাম থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের বহরমপুর পৌরসভায় ‘কাগজ তুলতে’ আসেন বছর ৬৫-র আবুল কাসেম শেখ। তাঁর মেয়ের জন্মের পরিচয় পত্র হিসেবে সম্বল বহরমপুরের একটি বেসরকারি নার্সিং হোম থেকে পাওয়া গোলাপি রঙের ‘হাতে লেখা’ একটি কাগজ।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে কাসেম শেখের মতই প্রায় ৬০০-র বেশি মানুষ পৌরসভায় এসেছেন কাগজের আশায়। তিনি জানান, গ্রামের লোকজন নাকি তাঁকে বলেছে, “কাগজটা লাল থেকে সাদা করতে হবে”। একই কথা বলছেন নওদা থেকে আসা সামিরুন বিবি। নিজের ২০ আর ১৮ বছর বয়সী দুই ছেলের ডিজিট্যাল জন্মের শংসাপত্র করতে ৩৮ কিলোমিটার দূর থেকে শহরে এসেছেন তিনি। সামিরুন বিবির দুই ছেলেই পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করে। “কোনও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে কাগজ জোগাড় করতে হবে। এইভাবে প্রথমে SIR তারপর NRC আনবে। আগে আমাদের ভোটার অধিকার কাড়বে তারপর দেশ থেকেই তাড়িয়ে দেবে”।
অন্যদিকে, SIR-এর নামে সাধারণ মানুষকে হয়রান করা হচ্ছে বলে গোড়া থেকেই বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দেগে আসছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি অফিসগুলিকে কাগজপত্র নিয়ে আমজনতাকে সাহায্য করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন তিনি। বহরমপুর পৌরসভায় ‘ফর্ম সংশোধন’, ‘জন্মের বিলম্বিত শংসাপত্র’ এবং ডিজিটাইজেশনের জন্য আলাদা আলাদা কাউন্টার করা হয়েছে। প্রায় ৩৪ জন কর্মী-আধিকারিক এই কাজে নিযুক্ত হয়েছেন।
বহরমপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নাড়ু গোপাল মুখার্জি বলেন, “বিগত ১০ দিন ধরে মানুষের অত্যধিক চাপ রয়েছে। আগে যেখানে জন্মের শংসাপত্র সংশোধন বা ডিজিটাইজড করার ১০-১২ টা আবেদন পেতাম, বর্তমানে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৫০০-৬০০! সকাল ৭ টা থেকে মানুষ এসে অপেক্ষা করছেন”। মুর্শিদাবাদের জেলা আধিকারিক রাজর্ষি মিত্র বলেন, “এসডিও এবং ব্লক মেডিক্যাল অফিসাররা বিষয়টি দেখছেন। জন্মের শংসাপত্র ‘ডিজিটাইজড’ থাকার অর্থ হল সেটি ভুয়ো নয়। তাই এটি থাকা প্রয়োজন”।
অন্যদিকে, মালদার কালিয়াচকের জাজালপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুর বারেকের বক্তব্য, মানুষ অযথাই আতঙ্কিত হচ্ছে। বারংবার সচেতনতা প্রচার, আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও “২০০২ সালের ভোটার তালিকা দেখে মানুষ আতঙ্কিত হচ্ছে।” মুর্শিদাবাদের লালগোলার তৃণমূল MLA মহম্মদ আলি বলেন, “কোনও রাজনৈতিক দলই বিশেষ নিবিড় সংশোধনের বিরোধিতা করছে না। বাংলায় ২০০২ সালেও এটি করা হয়েছিল। কিন্তু আপত্তিটা হচ্ছে SIR এর নামে ঘুরপথে NRC ঢোকানো হচ্ছে। সেই ভয়েই মানুষ পৌরসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত, আদালতে ছুটছে।”
বরিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা তথা বহরমপুর লোকসভার প্রাক্তন সাংসদ অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, রাজ্য সরকার চাইলেই মানুষের এই আতঙ্ক দূর করতে পারে। কিন্তু ইচ্ছে করেই তারা তা করবে না। তাঁর কটাক্ষ, “এই পরিস্থিতি থেকে দুটি দলই ফায়দা নিচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিজেপি। ২০২১-এও NRC-র ভয় দেখিয়ে উনি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ভোট তুলেছেন। এবার ফের সংখ্যালঘুদের ভয় দেখিয়ে ভোট তুলতে মরিয়া”।