পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিতে (Khejuri) আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দলবদলের চিত্র আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এলাকার একটি সাংগঠনিক বৈঠকে তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতা-সহ প্রায় ৩০টি সংখ্যালঘু পরিবার বিজেপিতে যোগদান করায় রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। দলত্যাগীদের দাবি—এটি দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, অভিযোগ এবং অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ; আর শাসক দলের মতে—এই যোগদান “জোর করে বা ভুল বোঝানোর মাধ্যমে করা হয়েছে”।
ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছেন খেজুরি ১ ব্লকের কলাগেছিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার তৃণমূল নেতা শেখ মশিউর রহমান, যিনি তাঁর সমর্থকদের নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন। তাদের হাতে দলীয় পতাকা তুলে দেন কাঁথি লোকসভার সাংসদ সৌমেন্দু অধিকারী এবং খেজুরি বিধায়ক শান্তনু প্রামাণিক। বিজেপির দাবি—এটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলের “ভোটব্যাংক রাজনীতি”র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
বিজেপির দাবি—“সংখ্যালঘুদের মধ্যে তৃণমূলভীতি কমছে”
বৈঠকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সৌমেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেন যে তৃণমূল দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভুল তথ্য দিয়ে ভয় দেখিয়েছে। তাঁর কথায়—
“৩০টি সংখ্যালঘু পরিবার আজ আমাদের দলে যোগ দিয়েছে। এগিয়ে আরও মানুষ আসবেন। তৃণমূলের সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক একচেটিয়াত্বে মানুষের বিরক্তি আছে। পিসি-ভাইপোর আতঙ্কই এখন তৃণমূলের আসল সমস্যা।”
খেজুরির বিধায়ক শান্তনু প্রামাণিকও দাবি করেন যে বিধানসভা এলাকায় তিনি কখনোই কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত দেখাননি। তাঁর বক্তব্য—
“যে সংখ্যালঘুরা আজ যোগ দিলেন, তাঁরা ভয়ের আবহ কাটিয়ে এসেছেন। তৃণমূল তাঁদের ভুল বোঝাতে চেয়েছিল, কিন্তু মানুষ বাস্তব দেখছেন।”
দলত্যাগীদের অভিযোগ
শেখ মশিউর রহমান, যিনি তৃণমূল নেতৃত্বে ছিলেন, দাবি করেন—
“দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচারিত হচ্ছিলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিমদের নিয়ে রাজনৈতিক খেলা করছেন। উন্নয়নের প্রশ্নে আমাদের কথা কেউ শুনছিল না।”
তবে এই অভিযোগের কোনও স্বাধীন যাচাই এখনও পাওয়া যায়নি।
তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া—“টাকার লোভ দেখানো হয়েছে”
স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব দলবদলকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাদের দাবি—
“বিজেপি টাকা দেখিয়ে লোক টানছে। মানুষের সমর্থন তারা হারাচ্ছে, এখন কৃত্রিমভাবে সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সময়ই বিচার করবে।”
তৃণমূল আরও দাবি করেছে যে দলত্যাগ “ব্যক্তিগত বৈরিতা এবং সুযোগসন্ধানী রাজনীতির” ফল।
আসন্ন নির্বাচনে প্রভাব পড়বে?
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পূর্ব মেদিনীপুরে দু’টি আসনেই বিজেপি এগিয়ে ছিল। বেশিরভাগ বিধানসভাতেই তারা লিড পায়, পটাশপুর ছাড়া। ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, খেজুরির এই দলবদল আগামী ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে—
-
যদি সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে বিভাজন তৈরি হয়,
-
এবং যদি দলবদলের প্রবণতা ছড়ায়,
তাহলে খেজুরি—যা দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি—সেখানে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
তবে এই ধরনের দলত্যাগ পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতিতে নতুন নয়। নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বিভিন্ন জেলার বহু ব্লকে দলবদলের ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকক্ষেত্রে তা ভোটের ফলাফলে বিশেষ প্রভাব ফেলে, অনেকক্ষেত্রে আবার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে।
নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ
প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে—
-
বিজেপি দলবদলকে নিজের পক্ষে ইতিবাচক বার্তা হিসেবে প্রচার করছে।
-
তৃণমূল বিষয়টিকে “অবৈধ প্রলোভনের ফল” বলে দাবি করছে।
-
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থান নিয়ে উভয় পক্ষই আলাদা বয়ান দিচ্ছে।
কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে—এ ধরনের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে ভোটে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
কারণ—
✔ স্থানীয় গণতান্ত্রিক সমীকরণ,
✔ প্রার্থী নির্বাচন,
✔ ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি,
এসবই মিলিয়ে ফলাফল নির্ধারিত হয়।
খেজুরিতে ৩০টি সংখ্যালঘু পরিবারের বিজেপিতে যোগদান নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে। তবে এর প্রভাব কতটা গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা ভবিষ্যত রাজনৈতিক পরিবেশই বলে দেবে। উভয় দলের পক্ষ থেকেই ঘটনাটিকে প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু ভোটারদের প্রতিক্রিয়া এবং আসন্ন নির্বাচনের বাস্তব পরিস্থিতি শেষ শব্দটি বলবে।
