রাজকীয় শিকারের মাঠ প্রকৃতি পর্যটনের কেন্দ্র আলিপুরদুয়ারের রাজাভাতখাওয়া

আলিপুরদুয়ারের বুকসা টাইগার রিজার্ভের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত রাজাভাতখাওয়া (Rajabhatkhawa) একটি ছোট্ট গ্রাম, যা পশ্চিমবঙ্গের দোয়ার্স অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য বিখ্যাত। এই গ্রামের…

Rajabhatkhawa in Alipurduar: From Royal Hunting Ground to Eco-Tourism Hub

আলিপুরদুয়ারের বুকসা টাইগার রিজার্ভের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত রাজাভাতখাওয়া (Rajabhatkhawa) একটি ছোট্ট গ্রাম, যা পশ্চিমবঙ্গের দোয়ার্স অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য বিখ্যাত। এই গ্রামের নামের পিছনে রয়েছে একটি আকর্ষণীয় গল্প, যা কুচবিহারের রাজপরিবারের সঙ্গে জড়িত। একসময় এই অঞ্চল ছিল রাজাদের শিকারের মাঠ, যেখানে কুচবিহারের রাজারা তাঁদের শিকার অভিযানের জন্য আসতেন। আজ রাজাভাতখাওয়া পরিণত হয়েছে প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্যে, যেখানে বুকসা টাইগার রিজার্ভের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং ঘন জঙ্গল পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এই নিবন্ধে আমরা রাজাভাতখাওয়ার ঐতিহাসিক পটভূমি, রাজকীয় শিকারের গল্প এবং বর্তমানে এর পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।

রাজাভাতখাওয়ার ঐতিহাসিক পটভূমি
রাজাভাতখাওয়ার নামের উৎপত্তি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত। ১৮০০ সালের দিকে কুচবিহারের রাজা ভুটানের শাসকের কাছ থেকে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তিনি শপথ নিয়েছিলেন যে, এই অঞ্চল ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত তিনি ভাত খাবেন না। পরবর্তীকালে, ভুটানের রাজা শান্তিপূর্ণভাবে এই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই ঘটনার পর দুই রাজার মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ মিলন হয়, এবং তারা এই ঘন জঙ্গলে একসঙ্গে ভাত খেয়ে উৎসব করেন। এই ঘটনা থেকেই এই স্থানের নাম হয় ‘রাজাভাতখাওয়া’, যার অর্থ ‘রাজা যেখানে ভাত খেয়েছিলেন’। এই গল্পটি স্থানীয় লোককথার অংশ হয়ে আজও জনপ্রিয়।

   

এছাড়াও, রাজাভাতখাওয়া কুচবিহারের রাজাদের শিকারের মাঠ হিসেবে পরিচিত ছিল। লোককথা অনুসারে, কুচবিহারের রাজারা এখানে পিকনিক এবং শিকার অভিযানের জন্য আসতেন। এই অঞ্চলের ঘন জঙ্গল এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রাজাদের শিকারের জন্য আদর্শ ছিল। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশরা কুচবিহারের রাজার আমন্ত্রণে বুকসা দুর্গ দখল করে, যা তখন ভুটানের রাজার নিয়ন্ত্রণে ছিল। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলের বনজ সম্পদ, বিশেষ করে রেলওয়ে নির্মাণের জন্য কাঠের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে কুচবিহারের রাজার পক্ষে ভুটানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৭৭৪ সালে ভুটানের রাজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং কুচবিহারের রাজাকে মুক্ত করেন। এই ঘটনার পর রাজাভাতখাওয়ায় রাজপরিবারের জন্য একটি বড় ভোজসভার আয়োজন করা হয়, যা এই স্থানের নামকরণের পিছনে আরেকটি কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

রাজকীয় শিকারের মাঠ
রাজাভাতখাওয়ার কাছাকাছি অবস্থিত চিলাপাতা জঙ্গলও একসময় কুচবিহারের রাজাদের শিকারের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই জঙ্গলে একসময় প্রচুর গণ্ডারের বাস ছিল, কিন্তু ১৮৯২ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে কুচবিহারের রাজার নির্দেশে ব্যাপক শিকারের ফলে গণ্ডারের সংখ্যা হ্রাস পায়। এই শিকার অভিযানগুলো রাজকীয় বিনোদনের অংশ ছিল এবং তৎকালীন রাজপরিবারের জন্য গর্বের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হত। তবে, এই শিকারের ফলে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা আজকের দিনে সংরক্ষণের গুরুত্বকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে।

বর্তমানে রাজাভাতখাওয়া: প্রকৃতি পর্যটনের কেন্দ্র
১৯৮৩ সালে বুকসা টাইগার রিজার্ভ প্রতিষ্ঠার পর রাজাভাতখাওয়া পর্যটনের কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসে। এই অঞ্চলের ঘন জঙ্গল, বৈচিত্র্যময় জীবজন্তু এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বুকসা টাইগার রিজার্ভে রয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, এশিয়ান হাতি, গৌর (ইন্ডিয়ান বাইসন), সাম্বার হরিণ, ক্লাউডেড লেপার্ড এবং ২৮৪ প্রজাতির পাখি। রাজাভাতখাওয়ায় অবস্থিত নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার পর্যটকদের জন্য বুকসা টাইগার রিজার্ভে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করে এবং এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে শিক্ষা দেয়।

Advertisements

রাজাভাতখাওয়ার আরেকটি আকর্ষণ হলো এখানকার ভালচার ব্রিডিং সেন্টার। ২০০৫ সালে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির (বিএনএইচএস) সহযোগিতায় এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে হোয়াইট-ব্যাকড, লং-বিলড এবং স্লেন্ডার-বিলড ভালচারের প্রজনন করা হয়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ১৬৯টি ভালচার রয়েছে, এবং গত তিন বছরে ৩১টি ভালচার বুনোতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই কেন্দ্র থেকে ছাড়া দুটি ভালচার বুনোতে একটি ছানার জন্ম দেয়, যা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক।

পর্যটন সম্ভাবনা
রাজাভাতখাওয়ায় পর্যটকরা জঙ্গল সাফারি, পাখি পর্যবেক্ষণ এবং ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারেন। এখানকার অর্কিডারিয়ামে রয়েছে ১৫০০ প্রজাতির অর্কিড, যা প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া, এখানকার অ্যানিমাল রেসকিউ সেন্টারে আহত বাঘ এবং চিতাবাঘের চিকিৎসা করা হয়। জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত ওয়াচটাওয়ার থেকে হাতি, গৌর এবং এমনকি বাঘ দেখার সুযোগ রয়েছে।

রাজাভাতখাওয়া আলিপুরদুয়ার থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার এবং শিলিগুড়ি থেকে ১৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি সড়ক এবং রেলপথে সহজেই পৌঁছানো যায়। নিকটতম রেলস্টেশন হলো রাজাভাতখাওয়া রেলওয়ে স্টেশন, এবং নিকটতম বিমানবন্দর হলো বাগডোগরা, যা ১৬০ কিলোমিটার দূরে। শীতকাল (অক্টোবর থেকে মার্চ) এখানে ভ্রমণের জন্য সেরা সময়, কারণ বর্ষাকালে (১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর) বুকসা টাইগার রিজার্ভ পর্যটকদের জন্য বন্ধ থাকে।

রাজাভাতখাওয়া একসময় কুচবিহারের রাজাদের শিকারের মাঠ হলেও, আজ এটি প্রকৃতি পর্যটন এবং সংরক্ষণের একটি প্রধান কেন্দ্র। এর ঐতিহাসিক গল্প, রাজকীয় উত্তরাধিকার এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এটিকে পর্যটকদের কাছে একটি অনন্য গন্তব্য করে তুলেছে। বুকসা টাইগার রিজার্ভের প্রবেশদ্বার হিসেবে রাজাভাতখাওয়া প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। এখানকার জঙ্গল সাফারি, ভালচার সংরক্ষণ কেন্দ্র এবং অর্কিডারিয়াম পর্যটকদের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করে। রাজাভাতখাওয়ার এই যাত্রা ইতিহাস, প্রকৃতি এবং সংরক্ষণের এক অপূর্ব মেলবন্ধনের সাক্ষী।