শারদোৎসব যেন উত্তরবঙ্গের চা-বাগান (North BengalTea Garden) এলাকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। পুজোর আর মাত্র মাসখানেক বাকি। এর মধ্যেই চা শ্রমিক পরিবারগুলির মধ্যে উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তবে এই প্রস্তুতির আসল প্রাণশক্তি হল ‘বোনাস’। বছরের পর বছর ধরে পুজোর আগে বোনাস ঘোষণা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়, উত্তরবঙ্গের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহে এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে আসছে।
চা শ্রমিকদের(North BengalTea Garden) কাছে বোনাস মানে শুধু কয়েক হাজার টাকার প্রাপ্তি নয়, বরং পুজোর উৎসবমুখর দিনগুলির আশ্বাস। এই টাকাই তাদের ঘরে ফেরায় উচ্ছ্বাস। ডুয়ার্স ও তরাই অঞ্চলের অর্থনীতি এই বোনাসের উপর নির্ভরশীল। কৃষক, হাট ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র দোকানদার থেকে শুরু করে শহুরে পাইকারি ব্যবসায়ী—সবার মুখেই তখন আনন্দের হাসি।
চা শ্রমিকরা (North BengalTea Garden) বছরের পর বছর পরিশ্রম করেন চা-বাগানের উষ্ণ রোদে, বৃষ্টিতে ভিজে, ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে। তাঁদের জীবনে সচ্ছলতার সুযোগ তেমন আসে না। তাই পুজোর আগে এই বোনাসের টাকা যেন এক আলোর রেখা হয়ে ধরা দেয়। শ্রমিকরা সেই টাকা নিয়ে স্থানীয় হাটে যান। সেখান থেকেই শুরু হয় কেনাকাটার উৎসব। নতুন জামা-কাপড়, শাড়ি, পাঞ্জাবি, বাচ্চাদের জন্য খেলনা, জুতো—সব কিছুই এই সময়ে হাটে জায়গা করে নেয়।
এমনকি হাট ব্যবসায়ীরাও এই মৌসুমের জন্য তৈরি থাকেন। তাঁরা জানেন, চা-বাগানের বোনাস এলে কেনাকাটা বাড়বে। তাই আগে থেকেই শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের মতো জেলা শহরের বড় বাজার থেকে প্রচুর পণ্য এনে মজুত করা হয়। ফলত, বোনাসের টানে হাট জমে ওঠে। ছোট ব্যবসায়ীও অতিরিক্ত লাভের আশায় সামগ্রী মজুত করেন।
এই বোনাসভিত্তিক কেনাবেচার অর্থনৈতিক প্রভাব শুধু চা শ্রমিকের ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকে না। কৃষকের ঘরেও আলো ছড়ায়। কারণ হাটে সবজি, চাল-ডাল, আনাজপত্র, ধান বিক্রি করে কৃষকরাও লাভ পান। সেই টাকা দিয়ে তারা ঘরের ভাঙা চাল মেরামত করেন, মেয়ের জন্য সালোয়ার-কামিজ কিনে আনেন, কিংবা পরিবারের জন্য বিশেষ রান্নার আয়োজন করেন।
চা শ্রমিকদের(North BengalTea Garden) ঘরে এই সময়ে এক ভিন্ন আবহ তৈরি হয়। বোনাসের টাকা হাতে এলেই ঘরে ঢোকে নতুন আশা। মা সন্তানের জন্য নতুন জামা কিনে আনেন। রান্নাঘরে চুলোর আঁচে ফোটে গরম মাংসের ঝোল। বছরের অন্য সময়ে যেখানে কেবল আলু-পটল বা ডালেই দিন কাটে, সেখানে এই উৎসবের সময়ে বিশেষ রান্না যেন এক অন্য রকম আনন্দ বয়ে আনে। শিশুদের হাসি, নতুন পোশাকের খুশি, একসঙ্গে বসে খাওয়ার আনন্দ—সব মিলিয়ে পুজো যেন প্রকৃত অর্থে পূর্ণতা পায়।
উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির প্রধান চাকা চা-শিল্প(North BengalTea Garden) । কিন্তু এই শিল্পের শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা বেশ দুর্বল। পুজোর আগে দেওয়া বোনাস সেই দুর্বলতার মধ্যে এক সাময়িক স্বস্তি বয়ে আনে। শুধু শ্রমিক নয়, তাঁরা যখন হাটে যান তখন স্থানীয় দর্জি, জুতো-সেলাই করা কারিগর, মিষ্টির দোকানদার—সবাই তার সুফল পান। তাই একে কেন্দ্র করে গোটা অঞ্চলে আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে।
ডুয়ার্সের মানুষদের কাছে দুর্গাপুজো মানে শুধু দেবীর আগমন নয়, বরং অর্থনৈতিক স্বস্তির আগমনও বটে। তাই চা-বাগানের বোনাসের ঘোষণা শোনামাত্রই শ্রমিক মহল্লায় যেন উৎসবের ঢাক বাজতে শুরু করে। এই বোনাস না থাকলে হয়তো অনেক পরিবারই নতুন জামা বা উৎসবের বিশেষ খাবারের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতেন।
অতএব, পুজোর আগে চা শ্রমিকদের হাতে আসা বোনাস উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিকে শুধু সচলই করে না, বরং মানুষের মুখে হাসি ফোটায়। ব্যবসায়ী থেকে কৃষক, শ্রমিক থেকে সাধারণ পরিবার—সবাই মিলে এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করে। এইভাবেই পুজো আসার আগেই বোনাসের টাকায় গোটা উত্তরবঙ্গ যেন একসঙ্গে শারদোৎসবকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে।

আমাদের Google News এ ফলো করুন
২৪ ঘণ্টার বাংলা নিউজ, ব্রেকিং আপডেট আর এক্সক্লুসিভ স্টোরি সবার আগে পেতে ফলো করুন।
