অয়ন দে, আলিপুরদুয়ার: জেলা হাসপাতালে (Alipurduar District Hospital) এক অসাধারণ জীবনযুদ্ধের সাক্ষী হলো এই অঞ্চলের মানুষ। মেটারনেটিভ হাব ইউনিটে চিকিৎসাধীন এক সদ্যোজাত শিশু, যার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল প্রায় নগণ্য, সে অবশেষে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এসে নিজের ঘরে ফিরল। এ যেন এক নতুন জীবনের সূচনা, যা শুধু শিশুটির পরিবারের জন্যই নয়, বরং পুরো হাসপাতালের জন্য এক অনুপ্রেরণার গল্প।
গত কয়েক সপ্তাহ আগে কোচবিহার জেলার বক্সিরহাট এলাকার এক পরিবারে জন্ম নেয় এই শিশু। জন্মের সময় শিশুটির ওজন ছিল অত্যন্ত কম, যা চিকিৎসকদের কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে শিশুটিকে দ্রুত স্থানান্তর করা হয় আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের মেটারনেটিভ কেয়ার ইউনিটে। শিশুটির শারীরিক অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে চিকিৎসকরা প্রথমে জানিয়েছিলেন, তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। শিশুটির পরিবারও প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার ফলে শিশুটি ধীরে ধীরে সুস্থতার পথে ফিরতে শুরু করে।
জেলা হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. অমিতাভ সাহা জানান, “শিশুটি যখন আমাদের কাছে আসে, তখন তার ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম ছিল। তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক ছিল। আমরা তাকে বিশেষ পর্যবেক্ষণে রেখে ইনকিউবেটরে স্থানান্তর করি। স্যালাইন, বিশেষ নিউট্রিশন এবং নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হই।” তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের ক্ষেত্রে ধৈর্য এবং সঠিক চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের টিমের প্রত্যেক সদস্য নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে শিশুটির জীবন বাঁচাতে কাজ করেছে।”
মেটারনেটিভ কেয়ার ইউনিটে প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসাধীন থাকার পর শিশুটির শারীরিক অবস্থা ক্রমশ উন্নত হতে থাকে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, সঠিক পুষ্টি এবং বিশেষ যত্নের ফলে শিশুটির ওজন স্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছায়। চিকিৎসকরা জানান, শিশুটির শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এখন স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে। এই সাফল্য শুধু শিশুটির জন্যই নয়, বরং হাসপাতালের পুরো টিমের জন্য একটি বড় মাইলফলক।
আজ, সোমবার সকালে, শিশুটিকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য কর্মীদের মুখে ছিল আনন্দের হাসি। শিশুটির মা-বাবা কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসিক্ত হয়ে বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম আমাদের সন্তানকে হারিয়ে ফেলব। কিন্তু আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের অসাধারণ প্রচেষ্টার জন্য আজ আমরা আমাদের সন্তানকে ফিরে পেয়েছি। তাঁদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।”
জেলা হাসপাতালের সুপার ডা. সুজিত রায় জানান, “আমাদের মেটারনেটিভ কেয়ার ইউনিট এই হাসপাতালের একটি গর্বের বিষয়। এই ইউনিটের মাধ্যমে আমরা ইতিমধ্যে বহু শিশুর জীবন রক্ষা করেছি। এই শিশুটির সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা আমাদের পুরো টিমের জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো প্রতিটি রোগীকে সর্বোত্তম চিকিৎসা প্রদান করা। এই ঘটনা আমাদের সেই প্রতিশ্রুতি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়।”
এই ঘটনা শুধু একটি শিশুর জীবন রক্ষার গল্প নয়, বরং এটি একটি দলের নিষ্ঠা, পেশাদারিত্ব এবং মানবিকতার প্রতিফলন। আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের এই সাফল্য এই অঞ্চলের স্বাস্থ্য পরিষেবার মান উন্নত করার প্রতি তাদের অঙ্গীকারকে আরও জোরালো করে। শিশুটির পরিবারের হাসি এবং হাসপাতালের কর্মীদের আনন্দ এই গল্পকে আরও অর্থবহ করে তুলেছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা এবং একটি নিবেদিত টিমের প্রচেষ্টা অসম্ভবকেও সম্ভব করে তুলতে পারে।
আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের এই সাফল্য এই অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি আশার আলো হয়ে থাকবে। এই গল্প শুধু একটি শিশুর জীবনের গল্প নয়, বরং এটি একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও ভরসার গল্প, যা আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিদিন নতুন করে লেখা হচ্ছে।