দার্জিলিং (Mirik) জেলার পাহাড়ি জনপদ যেন ক্রমাগত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ছে। গত কয়েক দিন ধরে টানা ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি ও পার্বত্য এলাকাগুলিকে একপ্রকার বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিশেষত দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও পার্শ্ববর্তী সিকিম জুড়ে এই বৃষ্টির প্রভাব স্পষ্ট। শ্রাবণ মাসের শুরু থেকেই যে বর্ষণ শুরু হয়েছিল, তা ক্রমশ তীব্র আকার নিয়েছে। পাহাড়ি ঢালে জমে থাকা জল এবং বৃষ্টির তীব্র চাপের ফলে মাটি আলগা হয়ে ক্রমাগত ভূমিধস নামছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দার্জিলিং জেলার ২৯ মাইল এলাকায়। শনিবার সেখানে ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের একটি বড় অংশ তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এই সড়কটি শুধু দার্জিলিং নয়, শিলিগুড়ি থেকে সিকিম সংযোগের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যেই চলতি সপ্তাহে এই সড়ক একাধিকবার ধসের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও সম্পূর্ণ, আবার কোথাও একদিক দিয়ে সীমিত যাতায়াত চলছে। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পর্যটক এবং পণ্যবাহী যানবাহন—সবাই পড়েছে মারাত্মক সমস্যায়।
শুধু ২৯ মাইল নয়, মিরিকেও (Mirik) ধসের খবর মিলেছে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা কাদা-পাথর গড়িয়ে পড়ে রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে, ভেঙে দিচ্ছে সড়কের বড় অংশ। শুক্রবার থেকেই লিউকিবীর এলাকা ভূমিধসে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। ফলে বিকল্প রাস্তা ধরতে হচ্ছে স্থানীয় মানুষদের, যা সময়সাপেক্ষ এবং বিপজ্জনক।
ন্যাশনাল হাইওয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (NHIDCL)-এর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, একাধিক জায়গায় পাহাড় কেটে নতুন রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। তবে টানা বৃষ্টি ও ধারাবাহিক ধসের কারণে কাজের গতি ব্যাহত হচ্ছে। অনেক জায়গায় রাস্তার মাটি এতটাই নরম হয়ে গেছে যে, স্থায়ী সমাধানের জন্য অতিরিক্ত সময় ও প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে। উপরন্তু, পাহাড়ের মাথা থেকে বড় পাথর গড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সবসময়ই থেকে যাচ্ছে, যা যাত্রীদের জন্য প্রাণঘাতী ঝুঁকি তৈরি করছে।
প্রশাসনের অভ্যন্তরেও এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, ধস যদি এই গতিতে চলতে থাকে, তবে আগামী দিনে ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। সেই সঙ্গে স্থানীয় অর্থনীতি, পর্যটন শিল্প, এবং দৈনন্দিন যোগাযোগ ব্যবস্থাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সিকিমেও একই চিত্র। টানা বৃষ্টিতে রাজ্যের একাধিক জায়গায় জাতীয় সড়ক ভেঙে পড়েছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে উত্তরবঙ্গ ও সিকিমের মধ্যে যানবাহন চলাচল কার্যত অচল। পর্যটকেরা আটকে পড়েছেন, পণ্য সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটছে, এবং চিকিৎসা-সহ জরুরি পরিষেবাগুলিও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
স্থানীয় মানুষ জানিয়েছেন, এর আগে এত ধারাবাহিক বৃষ্টি ও ধস একসঙ্গে দেখা যায়নি। পাহাড়ি ঢালগুলি অতিরিক্ত ভিজে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেও ধস নেমে আসছে। চাষাবাদ, চা-বাগান, ক্ষুদ্র ব্যবসা—সব ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমস্যার পিছনে শুধু প্রাকৃতিক কারণ নয়, মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত পাহাড় কেটে নির্মাণ কাজও দায়ী। যথাযথ জলনিকাশী ব্যবস্থা ও পাহাড়ি ঢালের স্থায়ী সংরক্ষণ না থাকায় বৃষ্টির সময় মাটি সহজে ধসে পড়ছে।
বর্তমানে প্রশাসন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং বিপর্যস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজে নজর দিচ্ছে। তবে যতদিন না আবহাওয়া স্বাভাবিক হচ্ছে, ততদিন ধসের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি মানুষের কাছে এই সময়টা নিঃসন্দেহে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার, যেখানে প্রতিটি দিন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে।