মালবাজারের রহস্যময় ভূতুড়ে ডাকবাংলোয় কেউ রাতে থাকে না!

উত্তরবঙ্গের মালবাজারের কাছে অবস্থিত লাটপঞ্চরের ডাকবাংলোটি (Malbazar Haunted Bungalow) যেন এক রহস্যের আড়ালে ঢাকা। পাহাড়ের কোলে, ঘন জঙ্গলের মাঝে এই ঔপনিবেশিক যুগের এই বাংলোটি শুধু…

Malbazar’s Haunted Latpanchor Dak Bungalow

উত্তরবঙ্গের মালবাজারের কাছে অবস্থিত লাটপঞ্চরের ডাকবাংলোটি (Malbazar Haunted Bungalow) যেন এক রহস্যের আড়ালে ঢাকা। পাহাড়ের কোলে, ঘন জঙ্গলের মাঝে এই ঔপনিবেশিক যুগের এই বাংলোটি শুধু তার প্রাচীন স্থাপত্যের জন্যই নয়, বরং ভূতুড়ে গল্পের জন্যও কুখ্যাত। স্থানীয়দের মতে, এই ডাকবাংলোতে রাত কাটানোর সাহস কেউ করে না। ব্রিটিশ আমলের এই বাংলোর চারপাশে জড়িয়ে আছে অলৌকিক ঘটনা, রহস্যময় মৃত্যু এবং ভৌতিক উপস্থিতির গল্প, যা আজও দুঃসাহসী পর্যটকদের দূরে রাখে। এই প্রতিবেদনে আমরা লাটপঞ্চরের এই ভূতুড়ে ডাকবাংলোর রহস্যময় ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করব।

ডাকবাংলোর ইতিহাস: ঔপনিবেশিক যুগের সাক্ষী
লাটপঞ্চরের ডাকবাংলোটি ১৮০০-এর দশকে ব্রিটিশ শাসনকালে নির্মিত হয়েছিল। ব্রিটিশরা ডাক পরিষেবা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য এই ধরনের বাংলো নির্মাণ করত। ঘন জঙ্গল, পাহাড়ি পথ এবং প্রত্যন্ত অবস্থানের কারণে এই বাংলোগুলো প্রায়শই বিচ্ছিন্ন থাকত। লাটপঞ্চরের এই বাংলোটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এটি মূলত ডাকবাহকদের বিশ্রামের জন্য এবং ব্রিটিশ অফিসারদের অস্থায়ী আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হত। তবে, স্থানীয়দের মতে, এই বাংলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু অমীমাংসিত মৃত্যুর ঘটনা। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই অঞ্চলে বেশ কিছু ব্রিটিশ সৈন্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু হয়েছিল, যা এই বাংলোর ভূতুড়ে খ্যাতির জন্ম দিয়েছে।

   

ভূতুড়ে গল্প: রাতের নিস্তব্ধতায় অলৌকিক উপস্থিতি
লাটপঞ্চরের ডাকবাংলোর চারপাশে অসংখ্য ভৌতিক গল্প প্রচলিত। স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেন, রাতের বেলা বাংলোর ভিতরে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়—পায়ের শব্দ, ফিসফিস কথা, এমনকি কান্নার আওয়াজ। কেউ কেউ বলেন, এক ব্রিটিশ অফিসারের আত্মা এখানে ঘুরে বেড়ায়, যিনি ম্যালেরিয়ায় মারা গিয়েছিলেন। আরেকটি গল্পে উঠে আসে এক স্থানীয় নারীর কথা, যিনি প্রেমে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই বাংলোর কাছে আত্মহত্যা করেছিলেন। তার আত্মা নাকি রাতের বেলা বাংলোর বারান্দায় দেখা যায়।

বাংলোর চৌকিদাররাও এই গল্পের সত্যতা মেনে নেন। একজন প্রবীণ চৌকিদার, রাম বাহাদুর, বলেন, “এখানে রাত কাটানোর সাহস কারোর নেই। আমি নিজে একবার রাতে বাংলোর ভিতরে অদ্ভুত ছায়া দেখেছি।” তিনি আরও জানান, বাংলোর পুরনো কাঠের দরজা-জানালা মাঝে মাঝে নিজে থেকেই খুলে যায়, যা সবাইকে ভয় পাইয়ে দেয়। এই ধরনের গল্পের কারণে পর্যটকরা দিনের বেলা বাংলোটি দেখতে এলেও রাতে থাকতে ভয় পান।

বর্তমান অবস্থা: পরিত্যক্ত কিন্তু আকর্ষণীয়
আজ লাটপঞ্চরের ডাকবাংলোটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এর দেয়ালে ফাটল ধরেছে, ছাদের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে, এবং ঘরগুলোতে মাকড়সার জাল আর ধুলোর স্তূপ। তবুও, এর ঔপনিবেশিক স্থাপত্য এবং রহস্যময় আবহ এখনও অক্সটকদের আকর্ষণ করে। দুঃসাহসী পর্যটক এবং ভৌতিক গল্পের শিকারীরা দিনের বেলা এখানে ছবি তুলতে এবং বাংলোর ইতিহাস জানতে আসেন। তবে, স্থানীয় প্রশাসন এবং বাংলোর তত্ত্বাবধায়করা রাতে এখানে থাকার বিরুধে সতর্ক করে দেন।

Advertisements

কিছু পর্যটক দাবি করেছেন, তারা বাংলোর কাছে গিয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। কলকাতার এক পর্যটক, অমিত রায়, বলেন, “দিনের বেলায় বাংলোটি সুন্দর, কিন্তু সন্ধ্যার পরে চারপাশের নিস্তব্ধে ভয় লাগে। আমরা স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনেছি, রাতে এখানে থাকলে অলৌকিক ঘটনা ঘটে।” এই ধরনের গল্পের কারণে বাংলোটি পর্যটকদের কাছে একটি রহস্যময় আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।

কেন ভূতুড়ে বলা হয়?
ডাকবাংলোগুলোর ভূতুড়ে খ্যাতির পিছনে কিছু ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। ব্রিটিশরা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই বাংলোগুলো নির্মাণ করেছিল, যেখানে প্রায়শই রোগ, দুর্ঘটনা বা সংঘর্ষে অনেকের মৃত্যু হত। এছাড়া, এই বাংলোগুলোর বিচ্ছিন্ন অবস্থান এবিশেষে, রাতের নিস্তব্ধতা এবং অন্ধকার মানুষের কল্পনাশীলতাকে উস্কে দিত। ভারতীয় লোকগাথার সঙ্গে ব্রিটিশ ভৌতিক গল্পগুলো মিশে এই বাংলোগুলোর চারপাশে রহস্যের জাল বুনেছে। লাটপঞ্চরের বাংলোটিও এর ব্যতিক্রম নয়।

প্রশাসনের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ
স্থানীয় প্রশাসন এই বাংলোটির সংরক্ষণের জন্য কিছু উদ্যোগগ নিয়েছে, তবে অর্থের অভাবে কাজ এগোয়নি। কিছু বিশেশজ্ঞ মনে করেন, এই বাংলোটিকে একটি ঐতিহ্যবাহী পর্যটন স্থানে রূপান্তর করা হয়। এর মাধ্যমে একদিকে ঐতিহাস সংরক্ষিত হবে, অন্যদিকে স্থানীয় অর্থনীতি উপকৃত হবে। তবে, ভূতুড়ে গল্পের কারণে এই উদ্যোগগ বাস্তবায়নে বাধা রয়েছে।

লাটপঞ্জনরের ডাকবাংলো শুধু একটি পৌরাণিক স্থাপনা নয়, এটি ইতিহাস, রহস্য এবং লোকগাথার একটি মিশ্রণ। এর ভূতুড়ে খ্যাতি সত্যি হোক বা কল্পনা, এই বাংলো মালবাজারের একটি অনন্য আকর্ষণ। দুঃসাহসী পর্যটকদের জন্য এটি একটি রোমাঞ্চকর গন্তব্য, তবে রাতে থাকার সাহস করা এখনও অনেকের জন্য চ্যালেঞ্জ। আপনি যদি রহস্য ও ভৌতিক গল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন, তাহলে লাটপঞ্চরের এই ডাকবাংলো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে—তবে রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দুবার ভেবে নিন!