অয়ন দে, আলিপুরদুয়ার: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি বেআইনি বালি পাচার (Illegal Sand Mining)। ধূপগুড়ি মহকুমার বানারহাট থানার অন্তর্গত রাঙাতি নদীতে এই পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ১২ জন গ্রামবাসী হামলার শিকার হয়েছেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছালে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, ফলে এলাকায় তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই ঘটনা রাজ্যে বেআইনি বালি পাচারের বিরুদ্ধে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার প্রতি গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাঙাতি নদী থেকে দীর্ঘদিন ধরে বেআইনিভাবে বালি তোলা হচ্ছে। এই বালি ডাম্পারে করে জনবসতিপূর্ণ এলাকার রাস্তা দিয়ে পরিবহন করা হয়, যা স্থানীয়দের জীবনযাত্রাকে বিপন্ন করছে। সম্প্রতি, নদীতে একটি ছাগল চলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসীদের সঙ্গে পাচারকারীদের বচসা শুরু হয়। এরপর যখন গ্রামবাসীরা বালি তোলার বিরুদ্ধে বাধা দেন, তখন পাচারকারীরা লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। এই হামলায় ১২ জন গ্রামবাসী, যাদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়ই রয়েছেন, আহত হন। আহতদের মাথা ফাটা, হাত-পা কাটা সহ গুরুতর চোট লাগে। তাদের বানারহাট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এই ঘটনায় রাঙাতি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, তারা বারবার ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার (বিডিও) থেকে শুরু করে বানারহাট থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন, কিন্তু প্রশাসনের তরফে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেআইনি বালি পাচার বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তবুও এই কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। গ্রামবাসীদের মতে, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিকের মদতেই পাচারকারীরা এতটা সাহস পাচ্ছে।
ঘটনার পর বানারহাট থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা, তা নিয়ে প্রশাসনের তরফে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তা তাদের হতাশ করেছে। তারা বলছেন, যদি প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তবে রাঙাতি নদী বালি মাফিয়াদের হাতে পুরোপুরি চলে যাবে, যা পরিবেশ ও স্থানীয় জনজীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি।
বেআইনি বালি পাচারের প্রভাব শুধু পরিবেশগত ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি নদীর তীরবর্তী এলাকার কৃষিজমি, জলস্তর এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত বালি তোলার কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বন্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়া, ডাম্পার চলাচলের কারণে গ্রামের রাস্তাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা স্থানীয়দের দৈনন্দিন জীবনে বাধা সৃষ্টি করছে।
এই ঘটনা প্রশাসনের কাছে একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কেন নীচুতলায় পৌঁছচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, বালি মাফিয়াদের সঙ্গে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আধিকারিকের যোগসাজশ রয়েছে, যার কারণে এই পাচার বন্ধ হচ্ছে না। তারা দাবি করেছেন, যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে তারা বড় আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন।
বানারহাটের এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের বেআইনি বালি পাচারের একটি বড় সমস্যাকে তুলে ধরেছে। এটি শুধু রাঙাতি নদীর সমস্যা নয়, বরং রাজ্যের বিভিন্ন নদীতে একই ধরনের কার্যকলাপ চলছে। প্রশাসনের কাছে এখন সময় এসেছে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে এই মাফিয়া নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলার। স্থানীয়দের নিরাপত্তা এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য দ্রুত তদন্ত এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অন্যথায়, এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আরও বড় আকার ধারণ করতে পারে।