উত্তরাঞ্চলে চা শিল্পে বৃষ্টির আশীর্বাদ: উৎপাদন ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে আশাবাদী চাষিরা

বাংলার প্রবাদবাক্য— “কারও পৌষ মাস, তো কারও সর্বনাশ”— ঠিক এভাবেই ধরা দিল উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের সাম্প্রতিক আবহাওয়ায়। একদিকে লাগাতার বর্ষণে ভাসছে বেশ কয়েকটি জেলা, অন্যদিকে…

Darjeeling tea

বাংলার প্রবাদবাক্য— “কারও পৌষ মাস, তো কারও সর্বনাশ”— ঠিক এভাবেই ধরা দিল উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের সাম্প্রতিক আবহাওয়ায়। একদিকে লাগাতার বর্ষণে ভাসছে বেশ কয়েকটি জেলা, অন্যদিকে এই বৃষ্টিই নতুন করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলাচ্ছে চা চাষিদের মনে। উত্তরবঙ্গের (North Bengal) চা বলয়ে গত কয়েক মাস ধরে অনাবৃষ্টি ও অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে চা গাছের অবস্থা বেহাল হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ক্ষুদ্র চা চাষিদের উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে আর্থিক সংকট চরমে পৌঁছেছিল। তবে আগস্টের শুরু থেকে ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণের ফলে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে।

ক্ষুদ্র চা চাষি সংগঠন সূত্রে খবর, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর এবং শিলিগুড়ি মহকুমা জুড়ে প্রায় ৫০ হাজার ক্ষুদ্র চা বাগান রয়েছে। এই বাগানগুলোতে বছরে গড়ে ১,২৫০ মিলিয়ন কেজি কাঁচা চা পাতা উৎপাদন হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পে নির্ভরশীল প্রায় এক লক্ষ শ্রমিক।

   

এবার ২৯ মে-তেই বর্ষা ঢুকলেও, প্রথমদিকে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল নগণ্য। তাপমাত্রা বেড়ে ৩৫–৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়, আর বাতাসে অতিরিক্ত আর্দ্রতা চা গাছে রোগ-পোকার আক্রমণ বাড়িয়ে তোলে। বিশেষ করে লুপার ও লাল মাকড়সার তাণ্ডবে হেক্টরের পর হেক্টর বাগানের পাতা নষ্ট হয়ে যায়। উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় চাষি ও শ্রমিকদের মধ্যে শঙ্কা বাড়ছিল।

ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফোরাম অফ স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রজত রায় কার্জি জানান, “আবহাওয়া পরিবর্তনের জেরে উৎপাদনের ঘাটতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত কয়েক বছরে লোকসানের ধাক্কায় উত্তরবঙ্গের পাহাড় ও সমতলে ১৯টি বড় চা বাগান বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। আরও অন্তত ১০টি চা বাগান ধুঁকে চলছে। পুজোর আগে এগুলোরও বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তবে সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণ চা শিল্পে নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে।”

নর্থ বেঙ্গল টি প্রডিউসার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি ও দার্জিলিং পাহাড়ের কয়েকটি চা বাগানের মালিক সতীশ মিত্রুকা বলেন, “এটা চা শিল্পে আশীর্বাদের মতো। মরশুমের শুরু থেকেই বৃষ্টির অভাবে উৎপাদন মার খেয়েছিল। এখন দেখা যাক, এই বৃষ্টি কতটা ঘাটতি পূরণ করতে পারে।”

Advertisements

চা বাগান শ্রমিকদের কথায়, বর্ষা দেরিতে শুরু হলেও এখনকার টানা বৃষ্টি গাছের বৃদ্ধি ও নতুন পাতার উৎপাদন বাড়িয়ে তুলবে। এতে রোগ-পোকার আক্রমণ কমবে এবং চা পাতার গুণগত মানও উন্নত হবে। এর ফলে চা পাতার বাজারদরও কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল এক মৌসুমের ভারী বৃষ্টি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সমাধান নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, শ্রমিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের দাম ওঠানামা—এই তিনটি বিষয় উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। তাই উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তি, সেচ ব্যবস্থা এবং কীটনাশক নিয়ন্ত্রণে আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার জরুরি।

বর্ষার দেরিতে হলেও আগমন উত্তরবঙ্গের চা শিল্পে সাময়িক স্বস্তি এনেছে। এখন দেখার বিষয়, এই বৃষ্টি পুজোর আগে চায়ের উৎপাদনে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাগানগুলোকে নতুন করে সচল করে তুলতে পারে কিনা।