অয়ন দে, কোচবিহার: কোচবিহার জেলার মাথাভাঙ্গা ২ ব্লকের লতাপাতা এলাকার এক প্রবীণ বাসিন্দার কাছে অসমের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নোটিশ (NRC Notice) এসেছে। এই ঘটনায় আবারও রাজ্য রাজনীতিতে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। নোটিশ প্রাপ্ত ব্যক্তি হলেন নিশিকান্ত দাস (৭২), যিনি পেশায় একজন খুচরা ডিম বিক্রেতা। তিনি বাড়ি বাড়ি থেকে ডিম সংগ্রহ করে বিক্রি করে সংসার চালান। এই নোটিশ তাঁর জীবনে নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে নিশিকান্ত দাসের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
নিশিকান্ত দাস জানিয়েছেন, প্রায় ২৮ থেকে ৩০ বছর আগে তিনি কাজের সন্ধানে অসমে গিয়েছিলেন। সেখানে গুয়াহাটির এয়ারপোর্ট সংলগ্ন ভিআইপি চৌপথি এলাকায় অসম পুলিশ তাঁকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করেছিল। তিনি যে ব্যক্তির অধীনে কাজ করছিলেন, তিনি থানায় গিয়ে স্পষ্ট করেছিলেন যে নিশিকান্ত কোচবিহারের বাসিন্দা এবং বাংলাদেশি নন। এরপর নিশিকান্ত বাড়ি ফিরে জমির দলিলসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে অসমে গিয়ে পুলিশের কাছে জমা দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে অসম পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়। প্রায় ছয় মাস কাজ করার পর তিনি অসম ছেড়ে কোচবিহারে ফিরে আসেন।
কিন্তু সম্প্রতি, প্রায় দেড় থেকে দুই মাস আগে, অসমের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে তাঁর কাছে এনআরসি নোটিশ এসেছে। নোটিশে তাঁকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বৈধ নথি জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিশিকান্ত দাস ১৯৬০ সালের জমির দলিল, ভোটার কার্ড, আধার কার্ডসহ বিভিন্ন প্রমাণপত্র নিয়ে অসমে গিয়ে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হন। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ তাঁর জমা দেওয়া নথিতে সন্তুষ্ট হয়নি। তারা ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকা এবং নিশিকান্তের বাবা দেবেন্দ্র চন্দ্র দাসের পরিচয়পত্র দাখিল করতে বলেছে। নিশিকান্ত জানান, তাঁর বাবা প্রায় ৪৫ বছর আগে মারা গেছেন। এই পরিস্থিতিতে এত পুরনো নথি সংগ্রহ করা তাঁর পক্ষে কার্যত অসম্ভব। এই ঘটনায় তিনি গভীরভাবে হতাশ এবং দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
এই ঘটনা কোচবিহার জেলায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর আগেও কোচবিহারের দিনহাটার বাসিন্দা উত্তম কুমার ব্রজবাসীর কাছে অসমের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে এনআরসি নোটিশ এসেছিল, যা রাজ্য রাজনীতিতে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ধর্মতলার সভায় উত্তম কুমারকে উপস্থিত করিয়েছিলেন এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে অসমের বিজেপি সরকার পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি কার্যকর করার চেষ্টা করছে, যা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নিশিকান্ত দাসের কাছে নতুন করে নোটিশ আসায় তৃণমূল কংগ্রেস সরব হয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের কোচবিহার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাবলু বর্মন জানিয়েছেন, “নিশিকান্ত দাসের এই নোটিশের বিষয়টি আমাদের কাছে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে আমরা দলগতভাবে বিষয়টির তদন্ত করছি। আমরা নিশিকান্ত দাসের পাশে আছি এবং তাঁকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করব।” তিনি আরও অভিযোগ করেন যে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাঙালিদের উপর নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “বাংলা ভাষা বলা কি অপরাধ? বিজেপি বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
এই ঘটনা কোচবিহারের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। রাজবংশী সম্প্রদায় উত্তরবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে বিবেচিত হয়। তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার জোরদার করেছে। দলের নেতারা অভিযোগ করছেন যে বিজেপি ইচ্ছাকৃতভাবে সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর হয়রানি চালাচ্ছে।
অন্যদিকে, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এই ধরনের নোটিশকে বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, রাজবংশী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এনআরসি মামলা প্রত্যাহারের জন্য অসম সরকার সুপারিশ করেছে। তবে, নিশিকান্ত দাসের মতো ব্যক্তিরা যখন এত পুরনো নথি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন, তখন তাঁদের উপর মানসিক ও আর্থিক চাপ বাড়ে।
নিশিকান্ত দাসের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাঁরা এই নোটিশের কারণে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তাঁরা বলছেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা এখানে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন। এখন হঠাৎ করে আমাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে কেন?” স্থানীয় বাসিন্দারাও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং সরকারের কাছে ন্যায়বিচার দাবি করেছেন।
এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমের মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও তীব্র করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনাকে বিজেপির “বাঙালি-বিরোধী” নীতির প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরছে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই ইস্যু উত্তরবঙ্গের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নিশিকান্ত দাসের মতো ব্যক্তিদের সমস্যা সমাধানে রাজ্য সরকার এবং জেলা প্রশাসন কী পদক্ষেপ নেয়, সেদিকে নজর রয়েছে সকলের।