অয়ন দে, উত্তরবঙ্গ: বাগডোগরার (Bagdogra Airport) রানওয়ে ছেড়ে বিমানটা ডানা মেলেছে সদ্য। ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে মেঠো পথঘাট, এশিয়ান হাইওয়ে, চা বাগান, আরও কত কী! জানলার পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে ভেসে যাচ্ছে মেঘের দল। সে সবকিছুকে আড়াল করে বিমানটা যেন থিতু হতে চাইছে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে। ডান পাশের উইন্ডো সিটে বসে এক প্রবীণ একমনে তাকিয়ে বাইরেটায়। বিস্ময় জাগে, দেখি তো কী এমন আছে!
দিল্লিগামী সেই বিমানে বসে থাকা গুরুগ্রামের এক ভদ্রলোক উঁকি দিয়েই বলে উঠলেন, ‘ওয়াও.. হোয়াট আ বিউটি…’, যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘বাহ… কী অপরূপ’। যাঁরা প্রথমবার বিমানে বাগডোগরা থেকে পশ্চিমে যাতায়াত করেন তাঁদের অনেকেই গুরুগ্রামের সেই ভদ্রলোকের মতো বিস্মিত হন। হন মুগ্ধও। অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে কি আর মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে!
পাহাড়িয়ারা বলেন, ‘ঘুমন্ত বুদ্ধ’। এই ঘুমন্ত বুদ্ধকে একবার দর্শনের টানেই রোজ হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ লোক পাড়ি দেন পাহাড়ে। কেউ যান সিকিম, কেউ দার্জিলিং, কেউ বা আবার অচেনা কোনও গ্রামে। অধিকাংশই আবার বাগডোগরাকে ছুঁয়ে। তাঁদের এই যাত্রাকে আরও স্মরণীয় করে তুলবে আগামীর বাগডোগরা বিমানবন্দর ।
উত্তরবঙ্গের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হিমালয় আর বিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই কারণেই বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনালের নকশায় থাকছে একেবারে কাঞ্চনজঙ্ঘার আদল। শুধু কি তাই, বিমানবন্দরে ঢুকলেও সেখান থেকে দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির মাঝে দর্শন দিতে পারে ঘুমন্ত বুদ্ধ। যদি আবহাওয়া সঙ্গ দেয়। খবরটায় উচ্ছ্বসিত দেশবন্ধুপাড়ার সুমিত মাঝি। বলছেন, ‘এ তো দারুণ ব্যাপার। আমাদের বিমানবন্দরের সঙ্গে কাঞ্জনজঙ্ঘার মিল! অপেক্ষায় রইলাম নতুন টার্মিনাল দেখার।’
বিমানবন্দরটির নতুন টার্মিনাল তৈরির দায়িত্ব পেয়েছে দেশের নামকরা একটি আর্কিটেক্ট সংস্থা। শুধু আদল নয়, বিমানবন্দরের নকশা তৈরিতে সবচেয়ে নাকি গুরুত্ব পেয়েছে আবহাওয়া এবং জলবায়ু। সংস্থাটি জানাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে হিমালয়ে। আবহাওয়া যেমন বদলে যাচ্ছে, তেমনই বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা থাকছে।
পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত দূষণও হচ্ছে। নতুন টার্মিনালের ক্ষেত্রে তাই এ সমস্তকিছু গুরুত্ব পেয়েছে। ‘গ্রিন বিল্ডিং’ তৈরি করে টার্মিনালটিকে যেমন দূষণমুক্ত রাখা হবে, তেমনই নতুন টার্মিনাল হবে জলবায়ু স্থিতিস্থাপক। যেহেতু এলাকাটি ভূকম্পন প্রবণ এলাকার মধ্যে রয়েছে, তার জন্য ভিত, কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে বলে সংস্থা সূত্রে খবর।
সংস্থার ম্যানেজিং প্রিন্সিপাল ডিসি কুকরেজার গলাতেও তৃপ্তির সুর। তিনি বলছেন, ‘প্রেক্ষাপট এবং জলবায়ু, উভয় ক্ষেত্রেই কীভাবে সাড়া দিতে পারে স্থাপত্য, তার উদাহরণ হতে পারে বাগডোগরা বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল।’
কোচি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যখন দেশে প্রথম ‘গ্রিন এনার্জি’র বিমানবন্দরের স্বীকৃতি পেয়েছিল তখন তা নিয়ে কৌতূহল কম ছিল না। ভারত তো বটেই, দেশের বাইরের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও গবেষকদের নজর পড়েছিল সেখানে। ভবিষ্যতে তাই চর্চা হতে পারে বাগডোগরা বিমানবন্দর নিয়েও। কেননা, সমস্ত ঝড়ঝাপটাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে নতুন টার্মিনালটি।
জলবায়ু ও আবহাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি বলেই মনে করছেন আবহাওয়া দপ্তরের সিকিমের কেন্দ্রীয় অধিকর্তা গোপীনাথ রাহা। তাঁর বক্তব্য, ‘বাগডোগরা বিমানবন্দর দেশীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব এই অঞ্চলেও মারাত্মকভাবে পড়ছে। ফলে এখানে নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।’
নিরাপত্তা এবং পরিচালনা সুনিশ্চিত করতে রিটেনিং ওয়াল, কালভার্ট এবং জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাতেও বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১২ লক্ষ বর্গ ফুটের নবনির্মিত টার্মিনালটিতে ঘণ্টায় এক হাজার যাত্রী একসঙ্গে বসতে পারবেন। এই পুরো কাজের জন্য খরচ হচ্ছে ১৫৬০ কোটি টাকা। ২০২৮-এর মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে।