অয়ন দে, আলিপুরদুয়ার: স্থানীয় প্যারেড গ্রাউন্ড, যা এই শহরের বাসিন্দাদের কাছে শুধু একটি মাঠ নয়, বরং খেলাধুলো, মর্নিং ওয়াক, শরীরচর্চা এবং নির্ভেজাল আড্ডার একটি প্রাণকেন্দ্র, তা এখন একটি দুঃখজনক অবস্থায় পড়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনসভার (PM Modi Rally) পর আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডের সাফাই না করার অভিযোগ উঠেছে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরুদ্ধে। গত ২৯ মে, ২০২৫, প্রধানমন্ত্রী আলিপুরদুয়ারে একটি প্রশাসনিক সভা এবং জনসভায় অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু সভার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও প্যারেড গ্রাউন্ডের হতশ্রী দশা দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশপ্রেমীরা। মাঠের বর্তমান অবস্থা এমন যে দূর থেকে দেখলে মনে হয় এটি কোনো আবাদি ক্ষেত। পেভার ব্লকের ব্যবহার, হেলিপ্যাড নির্মাণ এবং অপর্যাপ্ত সাফাই ব্যবস্থার কারণে মাঠের সবুজতা উধাও হয়ে গেছে, এবং জল জমে থাকায় ডেঙ্গুর মতো রোগের প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্যারেড গ্রাউন্ডের বর্তমান অবস্থা
প্রধানমন্ত্রীর জনসভার জন্য প্যারেড গ্রাউন্ডে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। হেলিপ্যাড নির্মাণ, পেভার ব্লক স্থাপন এবং সভার জন্য অস্থায়ী কাঠামো তৈরির ফলে মাঠের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে মাঠের চারদিকে জল জমে থইথই করছে, এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাবে এই জল বেরিয়ে যাচ্ছে না। এই অবস্থা শুধু মাঠের নান্দনিকতাই নষ্ট করেনি, বরং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও তৈরি করেছে। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, জমে থাকা জলের কারণে মশাবাহিত রোগ, বিশেষ করে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। গত বৃহস্পতিবার, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে, মাঠের এই হতশ্রী দশা দেখে পরিবেশপ্রেমীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, এই মাঠ শুধু খেলাধুলোর জন্য নয়, বরং শহরের ফুসফুস হিসেবে কাজ করে, যা এখন ধ্বংসের মুখে।

প্রশাসনের ভূমিকা ও বিজেপির অভিযোগ
জেলাশাসক, পুলিশ সুপার-সহ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্যারেড গ্রাউন্ডের অবস্থা পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু মাঠ সংস্কার বা সাফাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো স্পষ্ট দিশা বা পরিকল্পনা তাঁরা এখনও প্রকাশ করেননি। এই নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সভার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় সাফাই এবং মাঠের সংরক্ষণের বিষয়টি কেন গুরুত্ব পায়নি?
বিজেপির জেলা সভাপতি মিঠু দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তাঁরা দায়িত্ব এড়িয়ে প্রশাসনের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। মিঠু দাস বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সভা বা হেলিপ্যাড নির্মাণের জন্য মাঠের কোনো ক্ষতি হয়নি। এই বিষয়ে প্রশাসনই সবকিছু দেখাশোনা করবে।” তবে, স্থানীয়রা এই বক্তব্য মানতে নারাজ। তাঁদের মতে, বিজেপি এই জনসভার আয়োজন করেছিল, তাই মাঠের সাফাই ও সংরক্ষণের দায়িত্বও তাদের নেওয়া উচিত।
পরিবেশপ্রেমীদের ক্ষোভ
বিশ্ব পরিবেশ দিবসে প্যারেড গ্রাউন্ডের দুরবস্থা দেখে পরিবেশপ্রেমীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। স্থানীয় পরিবেশকর্মী শান্তনু রায় বলেন, “এই মাঠ শুধু খেলার জন্য নয়, এটি আমাদের শহরের একটি পরিবেশগত সম্পদ। এখানে সকালে শত শত মানুষ হাঁটতে আসেন, শিশুরা খেলাধুলো করে। কিন্তু এখন জল জমে থাকা এবং মাঠের সবুজতা নষ্ট হওয়ায় এটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।” তিনি আরও বলেন, প্রশাসন এবং বিজেপির উচিত এই বিষয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া। অন্য এক পরিবেশকর্মী, রীতা সেন, বলেন, “ডেঙ্গুর মতো রোগের প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা এখন বাস্তব। জল জমে থাকা এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
স্থানীয়দের উদ্বেগ
প্যারেড গ্রাউন্ড আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দাদের কাছে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এখানে সকাল-সন্ধ্যায় মানুষ হাঁটতে, খেলাধুলো করতে এবং আড্ডা দিতে আসেন। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় মাঠটি এই সব কার্যক্রমের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা অমিত সাহা বলেন, “এই মাঠ আমাদের শহরের গর্ব। কিন্তু এখন এটি দেখে মনে হয় যেন একটি পরিত্যক্ত জমি। প্রশাসন এবং বিজেপির উচিত দ্রুত এটি সংস্কার করা।” আরেক বাসিন্দা, মিতা দাস, বলেন, “আমরা আমাদের সন্তানদের এখানে খেলতে পাঠাতাম। কিন্তু এখন জল জমে থাকায় এবং মাঠের অবস্থা খারাপ হওয়ায় আমরা ভয় পাচ্ছি।”
প্রশাসনের নীরবতা
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা বা বিবৃতি দেওয়া হয়নি। জেলাশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মাঠের অবস্থা পরিদর্শন করা হয়েছে, কিন্তু সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল এবং পরিকল্পনা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এই নীরবতা স্থানীয়দের মধ্যে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সভার জন্য এত বড় আয়োজন করা সম্ভব হলে, মাঠ সংস্কারের জন্য কেন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না?
সমাধানের পথ
পরিবেশপ্রেমী এবং স্থানীয়রা দাবি করছেন, প্যারেড গ্রাউন্ডের সাফাই এবং সংস্কারের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রথমত, জমে থাকা জল নিষ্কাশনের জন্য উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মাঠের সবুজতা পুনরুদ্ধারের জন্য ঘাস রোপণ এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে এ ধরনের বড় আয়োজনের আগে মাঠের সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। স্থানীয় পরিবেশকর্মী শান্তনু রায় বলেন, “একটি সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে মাঠটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। প্রশাসন, বিজেপি এবং স্থানীয় সংগঠনগুলোর একযোগে কাজ করা উচিত।”
আলিপুরদুয়ারের প্যারেড গ্রাউন্ডের বর্তমান অবস্থা শুধু একটি সাফাই বিতর্ক নয়, এটি শহরের পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত একটি গুরুতর বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর জনসভার পর মাঠের এই দুরবস্থা স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা তৈরি করেছে। বিজেপির দায় এড়ানো এবং প্রশাসনের নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। প্যারেড গ্রাউন্ড শুধু একটি মাঠ নয়, এটি আলিপুরদুয়ারের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই, দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে এই মাঠের পূর্বের গৌরব ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।