মমতার আন্দোলনের জেরে কয়েক হাজার কোটির মাসুল দেবে জনতা- বিস্ফোরক দাবি বিকাশরঞ্জনের

সিঙ্গুর আন্দোলনের (Singur Movement) ঘটনাকে ঘিরে আবারও রাজনৈতিক তাপমাত্রা বাড়ল রাজ্যে। সিপিআইএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য (Bikash Ranjan Bhattacharya) শনিবার ফেসবুকে এক দীর্ঘ পোস্টে অভিযোগ…

Mamata's Singur Movement Cost Bengal Thousands of Crores, Claims CPI(M) MP Bikash Ranjan Bhattacharya

সিঙ্গুর আন্দোলনের (Singur Movement) ঘটনাকে ঘিরে আবারও রাজনৈতিক তাপমাত্রা বাড়ল রাজ্যে। সিপিআইএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য (Bikash Ranjan Bhattacharya) শনিবার ফেসবুকে এক দীর্ঘ পোস্টে অভিযোগ করেছেন, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হওয়া সিঙ্গুর আন্দোলন শুধু শিল্পহীনতার কারণ নয়, বরং এর ফলে রাজ্যের জনগণকে কয়েক হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতির বোঝা বইতে হচ্ছে।

ফেসবুক পোস্টে বিস্ফোরক অভিযোগ
বিকাশরঞ্জনের অভিযোগ, সিঙ্গুরের মোটরগাড়ি প্রকল্প গুজরাটে সরিয়ে নেওয়ার পেছনে ছিল এক জোটবদ্ধ ষড়যন্ত্র, যেখানে অংশ নিয়েছিল বিজেপি, মাওবাদী গোষ্ঠী ও একাংশ তথাকথিত বুদ্ধিজীবী। তাঁর দাবি, এই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন—
“সিঙ্গুরের মোটর গাড়ির কারখানা গুজরাটের হাতে তুলে দিতে যৌথ উদ্যোগ নিয়েছিল বিজেপি-মাওবাদী-তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, নেতৃত্বে মমতা। আজ সিঙ্গুরে সর্ষে চাষও হয় না অথচ অখ্যাত সানন্দ (গুজরাট) ঝলমলে শহর।”

   

দীর্ঘমেয়াদী ও তাৎক্ষণিক ক্ষতি
সাংসদের মতে, সিঙ্গুরে শিল্প হারানোর ক্ষতি শুধু কয়েক বছরের নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে অপ্রতিরোধ্য। কৃষি উৎপাদনও আগের মতো নেই। জমি ফিরিয়ে দেওয়ার পরও বহু ক্ষেত্র চাষযোগ্য অবস্থায় ফিরে আসেনি। তাঁর কথায়, “এটা গেল দীর্ঘকালীন ক্ষতি। এবার আসা যাক তাৎক্ষণিক ক্ষতির হিসেবের দিকে।”

বিকাশরঞ্জনের হিসেব অনুযায়ী—

  • কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা
  • টাটা গোষ্ঠীকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৬৬ কোটি টাকা
  • মামলাজনিত খরচ কয়েকশো কোটি টাকা

সব মিলিয়ে এই অর্থের বোঝা শেষ পর্যন্ত চাপবে রাজ্যের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। তিনি তীব্র ভাষায় মন্তব্য করেন—“এইসব ক্ষতিপূরণ করা হবে জনসাধারণের ঘাড় ভেঙে। ভাবুন। ভাবতে শিখুন।”

সিঙ্গুর বনাম সানন্দের বাস্তবতা
২০০৮ সালে টাটা মোটরসের ন্যানো কারখানা সিঙ্গুর থেকে গুজরাটের সানন্দে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত রাজ্যের শিল্প ইতিহাসে এক বড় মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তৎকালীন সানন্দ ছিল প্রায় অপরিচিত একটি শহর, কিন্তু টাটার বিনিয়োগের পর তা দ্রুত শিল্পনগরীতে পরিণত হয়। সেখানে নতুন নতুন শিল্প সংস্থার আগমন ঘটে, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিপুল অগ্রগতি হয়।

অন্যদিকে, সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনের পর আদালতের নির্দেশে কৃষকদের হাতে ফিরলেও, অনেক ক্ষেত্রেই জমি তার আগের উর্বরতা হারায়। বিকাশরঞ্জনের মতে, এই পরিস্থিতি সিঙ্গুরকে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে দিয়েছে, আর সানন্দকে এগিয়ে দিয়েছে।

Advertisements

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বিকাশরঞ্জনের মন্তব্যের রাজনৈতিক তাৎপর্যও গভীর। তাঁর বক্তব্য, সিঙ্গুর আন্দোলন ছিল এক রাজনৈতিক অস্ত্র, যার উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। তিনি অভিযোগ করেন, তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে মাওবাদী শক্তি ও বিজেপির মতো বিপরীত মতাদর্শের দল একত্রিত হয়েছিল। এই বিরল জোটের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার পালাবদল ঘটানো, যার মূল্য আজও দিচ্ছে রাজ্যের মানুষ।

প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক
তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এখনও বিকাশরঞ্জনের অভিযোগের সরাসরি জবাব না এলেও, দলীয় সূত্রে জানানো হয়েছে যে তাঁরা এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছে। তৃণমূল নেতাদের দাবি, সিঙ্গুর আন্দোলন ছিল কৃষকের জমি বাঁচানোর জন্য ন্যায়সঙ্গত লড়াই, যা পরবর্তীতে আদালতও স্বীকৃতি দিয়েছে।

বিজেপির তরফ থেকেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি, তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিকাশরঞ্জনের এই বক্তব্য সিঙ্গুর আন্দোলনের রাজনৈতিক মূল্যায়নে নতুন বিতর্ক উস্কে দিতে পারে।

অর্থনৈতিক বোঝা ও জনগণের প্রশ্ন
বিকাশরঞ্জনের পোস্টে মূল যে প্রশ্ন উঠে এসেছে, তা হলো—রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য কি রাজ্যের শিল্পোন্নয়নের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল? যদি তাই হয়, তবে তার অর্থনৈতিক ক্ষতির ভার কেন সাধারণ মানুষ বহন করবে? তাঁর আহ্বান—রাজ্যের নাগরিকদের রাজনৈতিক ঘটনাবলির পিছনের অর্থনৈতিক সত্য উপলব্ধি করা উচিত।

সিঙ্গুর আন্দোলন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আজও থামেনি। একদিকে রয়েছে তৃণমূলের দাবি—এটি ছিল কৃষকের অধিকার রক্ষার ঐতিহাসিক অধ্যায়। অন্যদিকে বিকাশরঞ্জনের মতো বিরোধী নেতাদের বক্তব্য—এটি ছিল পরিকল্পিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, যার মাসুল আজও দিচ্ছে রাজ্যের জনতা।

যেভাবে সিঙ্গুর বনাম সানন্দের তুলনা আবার সামনে এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে, এই বিতর্ক আগামী দিনে রাজ্য রাজনীতিতে আরও বড় ইস্যু হয়ে উঠতে চলেছে।