জাভেদ আখতারে নিষেধাজ্ঞা! শিবসেনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পাক শিল্পীকে কলকাতায় আনেন মমতা

ভারতীয় সংস্কৃতি মানেই বহুত্ববাদ ও ভিন্ন ধারার মিলন (Mamata)। কিন্তু বহু সময় রাজনৈতিক কারণে সেই সংস্কৃতির জগৎও বিপাকে পড়ে। সম্প্রতি বাংলার উর্দু একাডেমির একটি সভায়…

Mamata invites pak artist

ভারতীয় সংস্কৃতি মানেই বহুত্ববাদ ও ভিন্ন ধারার মিলন (Mamata)। কিন্তু বহু সময় রাজনৈতিক কারণে সেই সংস্কৃতির জগৎও বিপাকে পড়ে। সম্প্রতি বাংলার উর্দু একাডেমির একটি সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল প্রখ্যাত কবি এবং গীতিকার জাভেদ আখতারকে।

কিন্তু ধর্ম এবং বিশেষ করে মুসলিম ধর্ম নিয়ে তার মন্তব্য ঘিরে তৈরী হয়েছে বিতর্ক। এই বিতর্ককে উস্কে দিয়েই উর্দু একাডেমির অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা জাভেদ আখতার বিতর্ককে সমর্থন করে তাকে বয়কট করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে রাজ্য সরকার।

   

কিন্তু ২০১৫ সালে পাকিস্তানের কিংবদন্তি গজল গায়ক গুলাম আলি–কে নিয়ে তৈরি হয়েছিল এমনই এক বিতর্ক। শিবসেনার হুমকিতে মুম্বই ও পুনেতে তাঁর অনুষ্ঠান বাতিল হলেও, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান কলকাতায়।

শিবসেনার হুমকি ও অনুষ্ঠান বাতিল

অক্টোবর, ২০১৫। গুলাম আলি তখন ভারত সফরে আসেন। তাঁর গজল শোনার জন্য ভক্তদের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। কিন্তু ঠিক সেই সময় মহারাষ্ট্রের শিবসেনা সরব হয়। তাদের বক্তব্য ছিল, সীমান্তে পাকিস্তান যখন সন্ত্রাসবাদে মদত দিচ্ছে, তখন পাকিস্তানি শিল্পীরা ভারতের মঞ্চে উঠতে পারবেন না। হুঁশিয়ারির পরই গুলাম আলির মুম্বই ও পুনের অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয় আয়োজকরা।

এই ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন সংস্কৃতি জগতের একাংশ। তাঁদের মতে, সংগীত ও শিল্পের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশানো যায় না। সংগীতের ভাষা আলাদা, তার কোনো সীমানা নেই। কিন্তু শিবসেনা স্পষ্ট জানায়—তাদের অবস্থান বদলাবে না।

মমতার আমন্ত্রণ ও কলকাতার প্রস্তুতি

এই পরিস্থিতিতেই এগিয়ে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, “শিল্পীর কোনো দেশ হয় না। রাজনীতি নয়, সংগীতই আমাদের একসূত্রে বাঁধে।” এর পরই রাজ্য সরকার গুলাম আলিকে কলকাতায় আমন্ত্রণ জানায়। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তিনি কলকাতায় আসেন এবং নাজরুল মঞ্চে কনসার্টে অংশ নেন।

সেই অনুষ্ঠান ঘিরে কলকাতায় তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার শ্রোতা ছুটে আসেন। ভিড় সামলাতে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে পুলিশ। গুলাম আলি মঞ্চে উঠে কলকাতার মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “এ শহর আমার দ্বিতীয় বাড়ি। এখানে যে ভালবাসা পেয়েছি, তা আমি ভুলব না।”

প্রতিক্রিয়া: প্রশংসা ও সমালোচনা

মমতার এই পদক্ষেপে অনেকেই তাঁকে সাধুবাদ জানান। বিশেষত, শিল্পী মহল ও গুলাম আলির ভক্তরা মনে করেন, তিনি সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা করেছেন। দেশজুড়ে যখন একাংশ পাকিস্তানি শিল্পীদের বিরুদ্ধে সরব, তখন মমতার এই পদক্ষেপ ছিল সাহসী।

তবে সমালোচকরাও চুপ থাকেননি। তাঁদের মতে, সীমান্তে উত্তেজনার সময় পাকিস্তানি শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন। বিরোধীরা অভিযোগ তোলে, মমতা নাকি মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করার কৌশল নিয়েছিলেন। যদিও এই সমালোচনার জবাবে মমতা বলেন, “কলকাতা সবসময় সংস্কৃতির শহর। এখানে শিল্পীকে ধর্ম বা দেশের চোখে দেখা হয় না।”

Advertisements

জাভেদ আখতার প্রসঙ্গ

গুলাম আলির প্রসঙ্গ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মনে পড়ে যায় জাভেদ আখতারের সাম্প্রতিক বিতর্ক। পাকিস্তানে একটি সাহিত্য সম্মেলনে উপস্থিত থেকে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে কড়া মন্তব্য করেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।

পরে দেশে ফিরে তিনি আবার পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। এর জেরে অনেক সংগঠন তাঁর বিরুদ্ধে অনুষ্ঠান বয়কটের ডাক দেয়। যদিও গুলাম আলিকে নিয়ে সেই সময়কার বিতর্ক ছিল ভিন্ন প্রকৃতির—তাঁকে সরাসরি পাকিস্তানের শিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠতে দেওয়া হবে কি না, তাই ঘিরেই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল।

সংস্কৃতি বনাম রাজনীতি

ভারতে বহুবার দেখা গেছে, সীমান্ত উত্তেজনার সময় পাকিস্তানি শিল্পীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। কখনও সিনেমার শ্যুটিং বন্ধ হয়েছে, কখনও কনসার্ট বাতিল হয়েছে। কিন্তু এও সত্যি যে, সংগীত, কবিতা বা চলচ্চিত্র সবই মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িত। সীমান্তের টানাপোড়েনের মধ্যেও সাধারণ মানুষ শিল্পীদের কাছ থেকে শান্তির বার্তাই খুঁজে পান।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময় কলকাতাকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন এক ভিন্ন সাংস্কৃতিক মঞ্চ হিসেবে। যেখানে রাজনীতি নয়, শিল্পই অগ্রাধিকার পায়। তাঁর আমন্ত্রণে গুলাম আলির অনুষ্ঠান শুধু সংগীতের আসর ছিল না, বরং ছিল প্রতীকী বার্তা সংস্কৃতি সীমানা মানে না।

আজও গুলাম আলির সেই কলকাতা সফর আলোচনায় উঠে আসে। শিবসেনার হুমকি উপেক্ষা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা ইতিহাসে থেকে যাবে। একদিকে রাজনৈতিক চাপ, অন্যদিকে সংস্কৃতির মর্যাদা এই দুইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন দ্বিতীয়টিকে।

‘ট্রাম্প শুল্কেও অটুট ভারত’: জিডিপি প্রত্যাশা ছাড়াল, বললেন মোদী

আর সেটাই প্রমাণ করেছিল, জাভেদ আখতারের মতো বিতর্কিত মন্তব্য বা শিবসেনার চোখ রাঙানি যতই হোক না কেন, কলকাতার মঞ্চে সংগীতের জায়গা অটুট থাকবে।