মিলন পণ্ডা, দিঘা: পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘায় জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি পরিদর্শনে গিয়ে এক অভিনব দৃশ্যের সাক্ষী হলেন স্থানীয়রা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) বিকেলে দিঘার জগন্নাথ ঘাট সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছে একটি ‘রামভক্ত’ হনুমানকে চা ও বিস্কুট খাওয়ানোর সময় এক অনন্য মুহূর্ত সৃষ্টি করেন। এই ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যেখানে অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর এই স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক আচরণের প্রশংসা করেছেন। তবে, এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল দিঘার নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরে আগামী ২৭ জুন অনুষ্ঠিতব্য প্রথম রথযাত্রার প্রস্তুতি পরিদর্শন করা।
মুখ্যমন্ত্রী বুধবার দিঘায় পৌঁছান এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ সহ রাজ্যের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। রথযাত্রার প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে তিনি বৃহস্পতিবার দিনভর বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নেন এবং নির্দেশনা প্রদান করেন। দিঘা শঙ্করপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিএসডিএ), পুলিশ, এবং ইসকনের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে তিনি রথযাত্রার পথ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এবং ভিড় নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে মন্দিরে পূজার্চনা শুরু হবে, এবং দুপুর আড়াইটায় তিনি নিজে রথের রশি টেনে এই ঐতিহাসিক রথযাত্রার সূচনা করবেন।
নিরাপত্তা ও ভিড় নিয়ন্ত্রণে কড়া নির্দেশ
দিঘার এই রথযাত্রা প্রথমবারের মতো আয়োজিত হচ্ছে, এবং এটি প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ ভক্তের সমাগম ঘটাবে বলে প্রত্যাশিত। বিগত বছরগুলিতে ভারতে ধর্মীয় উৎসবের সময় পদপিষ্টের মতো দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “রাস্তায় কোনও ভক্তকে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না। ব্যারিকেডের মাধ্যমে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা হবে, এবং ভক্তরা ব্যারিকেডের পাশ থেকে রথের রশি স্পর্শ করে প্রণাম করতে পারবেন।” এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রায় ১,০০০ পুলিশ কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন করা হয়েছে।
রথযাত্রার জন্য বিশেষ আয়োজন
দিঘার জগন্নাথ মন্দিরটি গত ৩০ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রীর হাতে উদ্বোধন করা হয়েছিল। এই মন্দির পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের একটি প্রতিরূপ হিসেবে নির্মিত হয়েছে এবং এটি ইতিমধ্যেই ধর্মীয় ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রথযাত্রার জন্য তিনটি রথ—জগন্নাথ, বলভদ্র, এবং সুভদ্রার জন্য—প্রস্তুত করা হয়েছে। রথটি নতুন জগন্নাথ মন্দির থেকে পুরনো মন্দির পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে। ভক্তদের দর্শনের সুবিধার্থে রথ বিভিন্ন স্থানে থামবে, যাতে সকলে জগন্নাথ দেবের দর্শন পান।
পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ
রথযাত্রার পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষার দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দিঘার সমুদ্র সৈকত এলাকায় প্লাস্টিক-মুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার জন্য পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে প্লাস্টিকের পাউচে পানীয় জল সরবরাহ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তে, ৩০-৪০টি জলের কিয়স্ক স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে কাগজের কাপে পানীয় জল দেওয়া হবে। এছাড়া, ৪৫০ জন স্যানিটেশন কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে।
রাজনৈতিক বিতর্ক ও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য
দিঘার রথযাত্রা ও জগন্নাথ মন্দির নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও উঠেছে। বিজেপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই উৎসবের মাধ্যমে হিন্দু ভোটারদের সমর্থন পেতে চাইছেন। তবে মুখ্যমন্ত্রী এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “পুরীর জগন্নাথ মন্দির আমরা ভালোবাসি। দিঘার রথযাত্রা পুরীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা নয়। এটি একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব, যা বিদেশি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করবে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই উৎসবের মাধ্যমে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও পর্যটন বৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিঘা সফর শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসবের প্রস্তুতির জন্যই নয়, এটি স্থানীয় অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। হনুমানকে চা-বিস্কুট খাওয়ানোর মতো স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা তাঁর জনমানসে ঘনিষ্ঠতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। রথযাত্রার এই ঐতিহাসিক আয়োজন দিঘাকে একটি নতুন ধর্মীয় ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।