পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়ায় শনিবার এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল। হলদিয়া ডক ইনস্টিটিউটের (Haldia Dock Election) পরিচালন সমিতির নির্বাচনে বাম সমর্থিত প্রগতিশীল জোটের জয়ের পর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন বাম নেতাকর্মীরা। তবে, এই উৎসবের রঙ ছিল একটু অস্বাভাবিক—লাল নয়, সবুজ আবীরে মেতে উঠলেন তারা। তৃণমূল সমর্থিত আইএনটিটিইউসি এই ভোটে পরাজিত হয়েছে, আর বামেদের এই জয়ে সবুজ আবীরের উড়ান নানা প্রশ্ন তুলেছে।
শুক্রবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ভোটগ্রহণ হয়। এই নির্বাচনে ১৯টি আসনে মোট ৫৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। শনিবার ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায়, বাম শ্রমিক সংগঠন সিটু-র নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল জোট ১৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। অন্যদিকে, তৃণমূল সমর্থিত আইএনটিটিইউসি পেয়েছে মাত্র ৬টি আসন। পরিচালন সমিতির সহ-সভাপতি পদে জয়ী হয়েছেন আইএনটিটিইউসি-র প্রার্থী। বিজেপি এই নির্বাচনে কোনও আসনই জিততে পারেনি, তাদের খাতা শূন্য থেকেছে।
বামেদের ধারাবাহিক সাফল্য
এর আগে ২০২৩ সালেও হলদিয়া ডক ইনস্টিটিউটের পরিচালন সমিতির নির্বাচনে বাম প্রগতিশীল জোট সমস্ত আসনে জয়ী হয়ে সম্পূর্ণ দখল নিয়েছিল। এবার আসন সংখ্যা কিছুটা কমলেও, ১৩টি আসন জিতে তারা তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। এই জয়ের পর হলদিয়ার বন্দর এলাকায় বাম নেতাকর্মীরা সবুজ আবীর মেখে ও উড়িয়ে বিজয় উৎসব পালন করেন। তবে, এই সবুজ আবীরের ব্যবহার নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা।
সাধারণত বামেদের সঙ্গে লাল রঙের একটি ঐতিহ্যগত সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এবার তারা লাল আবীরের পরিবর্তে সবুজ আবীর ব্যবহার করলেন কেন? সবুজ রঙ তো সাধারণত তৃণমূল কংগ্রেস বা কংগ্রেসের বিজয় উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। সম্প্রতি সিপিআইএম-এর সোশাল মিডিয়ায় লাল রঙ ছেড়ে নীল আকাশের মাঝে প্রতীক আঁকা একটি ছবি পোস্ট করা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। হলদিয়ার এই সবুজ আবীর কি তেমনই কোনও নতুন ইঙ্গিত বহন করছে?
সবুজ আবীরের রহস্য
এই ঘটনায় নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। হলদিয়ার সিটু নেতৃত্ব এ বিষয়ে জানিয়েছে, “আমাদের কাছে কোনও আবীর ছিল না। তাই যা পাওয়া গেছে, সেই সবুজ আবীর দিয়েই বিজয় উৎসব পালন করা হয়েছে।” তবে, এই ব্যাখ্যা আরও প্রশ্ন তুলেছে। আবীর ছিল না মানে কী? আর সবুজ আবীরই বা কেন পাওয়া গেল?
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভোটের ফল ঘোষণার পর উৎসবের জন্য আবীর কিনতে গিয়ে এক বাম কর্মী বাজারে লাল আবীর পাননি। দোকানে শুধু সবুজ এবং গেরুয়া রঙের আবীর পাওয়া যাচ্ছিল। গেরুয়া রঙ বিজেপির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এবং বামেদের মতাদর্শগত বিরোধিতার কারণে তিনি তা বর্জন করেন। ফলে, বাকি থাকা সবুজ আবীরই কেনা হয়। এরপর সেই সবুজ আবীর মেখে এবং উড়িয়ে বাম শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা জয়ের উৎসব পালন করেন।
বামেদের কাছে জয়ের তাৎপর্য
হলদিয়া বন্দর এলাকায় এই জয় বামেদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের মধ্যে তাদের প্রভাব এবং সংগঠনের শক্তি এই জয়ের মাধ্যমে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। সিটু নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল জোট গত কয়েক বছরে এই এলাকায় তাদের ভিত মজবুত করেছে। ২০২৩ সালে সম্পূর্ণ আধিপত্যের পর এবারও তারা তৃণমূলকে পরাস্ত করে শ্রমিকদের সমর্থন ধরে রেখেছে।
অন্যদিকে, তৃণমূলের জন্য এই পরাজয় একটি বড় ধাক্কা। রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল হওয়া সত্ত্বেও হলদিয়ার শ্রমিকদের মধ্যে তাদের প্রভাব কমে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়। আইএনটিটিইউসি মাত্র ৬টি আসনে জিতলেও, পরিচালন সমিতির সহ-সভাপতি পদে তাদের প্রার্থীর জয় কিছুটা সান্ত্বনা দিয়েছে। তবে, সামগ্রিকভাবে এই ফলাফল তৃণমূলের জন্য হতাশাজনক।
সবুজ আবীর নিয়ে আলোচনা
সবুজ আবীরের ব্যবহার নিয়ে বাম সমর্থকদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একদলের মতে, এটি কেবল একটি পরিস্থিতিজনিত ঘটনা এবং এর মধ্যে কোনও রাজনৈতিক ইঙ্গিত খোঁজা অর্থহীন। তবে, আরেকদল মনে করছেন, এটি বামেদের নতুন কৌশল বা ইমেজ পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত হতে পারে। সম্প্রতি সিপিআইএম-এর নীল আকাশে প্রতীক আঁকা পোস্ট নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছিল, তার সঙ্গে এই সবুজ আবীরের ঘটনাকে অনেকে যুক্ত করছেন।
স্থানীয় এক বাম নেতা জানান, “আমাদের লড়াই শ্রমিকদের অধিকারের জন্য। আবীরের রঙ দিয়ে এর তাৎপর্য বিচার করা উচিত নয়। বাজারে লাল আবীর না থাকায় আমরা যা পেয়েছি, তাই ব্যবহার করেছি।” তবে, এই ব্যাখ্যা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সোশাল মিডিয়ায় অনেকে মজা করে বলছেন, “বামেরা কি সবুজে রঙ বদলাচ্ছে?”
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
হলদিয়ার এই নির্বাচন রাজ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় থাকলেও, শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে বামেদের প্রভাব এখনও উল্লেখযোগ্য। বিজেপির এই নির্বাচনে কোনও প্রভাব না ফেলতে পারা তাদের দুর্বলতাও প্রকাশ করেছে। বামেদের এই জয় তাদের কর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা আনতে পারে।
তৃণমূলের এক নেতা জানান, “এই ফলাফল আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। আমাদের শ্রমিকদের মধ্যে আরও কাজ করতে হবে।” অন্যদিকে, বাম নেতৃত্বের দাবি, “এই জয় প্রমাণ করে যে শ্রমিকরা এখনও আমাদের উপর ভরসা রাখে।”
হলদিয়া ডক ইনস্টিটিউটের পরিচালন সমিতির নির্বাচনে বামেদের জয় এবং সবুজ আবীরে উৎসব একটি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এটি কেবল একটি ভোটের ফলাফল নয়, বরং শ্রমিকদের মধ্যে বামেদের শক্তি এবং তৃণমূলের দুর্বলতার প্রতিফলন। সবুজ আবীরের ব্যবহার যদিও পরিস্থিতিজনিত বলে দাবি করা হচ্ছে, তবুও এটি রাজনৈতিক মহলে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। বামেদের এই জয় কি ভবিষ্যতে বড় কোনও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত? নাকি এটি কেবল একটি স্থানীয় সাফল্য? সময়ই তার উত্তর দেবে। তবে, হলদিয়ার এই সবুজ আবীরের উড়ান আপাতত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে।