কালীপুজোর বাজিতে ‘মোঘল সংস্কৃতি’ খুঁজে পেলেন বিকাশ

Bikashranjan Bhattacharyya claims firecrackers are not part of Hindu Diwali tradition but a legacy from the Sultanate and Mughal era, citing historical evidence

কলকাতা, ২০ অক্টোবর: দীপাবলি ও কালীপুজো মানেই আলো, আনন্দ আর রঙিন বাজির ঝলকানি। তবে এই বাজির সংস্কৃতি আদৌ কি হিন্দু ঐতিহ্যের অঙ্গ? না কি এর পেছনে রয়েছে অন্য ইতিহাস? রাজনীতিক ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এই প্রশ্ন তুলেই বিতর্ক উস্কে দিলেন। তাঁর দাবি—দীপাবলিতে বাজি পোড়ানো মোটেই প্রাচিন হিন্দু রীতি নয়, বরং এটি এসেছে সুলতানি ও মোঘল আমলের মাধ্যমে।

Advertisements

📜 প্রাচিন শাস্ত্রে বাজির উল্লেখ নেই

বিকাশরঞ্জনের বক্তব্য অনুযায়ী, হিন্দু ধর্মগ্রন্থের কোথাও বাজির উল্লেখ নেই। দীপাবলিকে বলা হয়েছে আলোর উৎসব, যেখানে প্রদীপ জ্বালানোই মূল রীতি।

  • স্কন্দপুরাণে (২৩তম অধ্যায়): কার্তিক অমাবস্যায় প্রদীপদান শ্রেষ্ঠ ধর্মকর্ম, যা দেবী লক্ষ্মীকে সন্তুষ্ট করে।
  • পদ্মপুরাণে (১২২তম অধ্যায়): প্রদীপ প্রজ্বলনকে অসংখ্য যজ্ঞের ফলের সমতুল্য মনে করা হয়েছে।
  • ভবিষ্যপুরাণে (১৮৫তম অধ্যায়): দীপাবলিকে সরাসরি ‘প্রদীপের সারির উৎসব’ বলা হয়েছে।

অর্থাৎ, প্রাচিন হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যে বাজি পোড়ানোর কোনও উল্লেখ নেই, বরং প্রদীপের আলোতেই ছিল উৎসবের মূল আয়োজন।

💣 চিনে জন্ম, মঙ্গোলদের হাত ধরে ভারতে

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, বাজির মূল উপাদান বারুদ বা গানপাউডার চিনে নবম শতাব্দীতে আবিষ্কৃত হয়। ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গোলদের হাত ধরে এটি ভারতে আসে।

  • ১২৫৮ সালে দিল্লি সুলতানি আমল: নাসিরুদ্দিন মাহমুদের শাসনকালে মঙ্গোল দূতকে সম্মান জানাতে প্রথম বাজি পোড়ানো হয়।
  • চতুর্দশ শতকে ফিরোজ শাহ তুঘলক: শবেবরাত উৎসবে বাজি ব্যবহার শুরু হয়।
  • পঞ্চদশ শতকে দক্ষিণ ভারত: চিনা বণিকদের মাধ্যমে বাজির বিস্তার ঘটে। বিজয়নগর সাম্রাজ্যে দশেরা উৎসবে বাজির উল্লেখ রয়েছে।

🏯 মোঘল আমলে রাজকীয় উৎসবে বাজি

মোঘল আমলে বাজি কেবল বিনোদন নয়, রাজকীয় আড়ম্বরের অংশে পরিণত হয়।

Advertisements
  • আকবর (১৫৮০): ফতেহপুর সিক্রিতে চিনা কারিগররা ৫,০০০ রকেট ও আকাশি ফুলের প্রদর্শনী করেন।
  • জাহাঙ্গীর (১৬১০): লাহোরে ২০,০০০ মুদ্রা খরচ করে চিনা কারিগর ডেকে এনে ১০০ ফুট উঁচু রকেট ও হাতি-আকৃতির বাজির প্রদর্শনী করেন।
  • শাহজাহান: কন্যা জাহানারার বিবাহে দিল্লিতে ১০,০০০ রঙিন বাজি পোড়ানো হয়। তাজমহলের উদ্বোধনেও প্রজাপতি-আকৃতির বাজির উল্লেখ মেলে।
  • আওরঙ্গজেব (১৬৬৬): শবেবরাতে কবুতর-আকৃতির রকেট আকাশে ছোঁড়া হয়।
🧨 উৎসব থেকে রাজনীতি

বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য কটাক্ষ করে বলেন, “আজ যারা নিজেদের হিন্দু সংস্কৃতির রক্ষক বলে দাবি করেন, তারা জানেন না দীপাবলিতে বাজি পোড়ানো মোটেই প্রাচিন ঐতিহ্য নয়। এটি সুলতানি ও মোঘল আমলের আমদানি। অথচ শব্দদূষণ ও পরিবেশদূষণ নিয়ে প্রশ্ন তুললেই হিন্দু বিরোধী তকমা দেওয়া হয়।”

তিনি আরও বলেন, প্রদীপ জ্বালানোই ছিল হিন্দু শাস্ত্রের নির্দেশ, আর দেবী লক্ষ্মীর আরাধনার প্রতীক। কিন্তু আজ বাজির উৎসবে সেই ঐতিহ্য চাপা পড়ছে।

🌍 পরিবেশ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

আজকের দিনে বাজি নিয়ে আরও একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। শব্দ ও বায়ুদূষণের কারণে আদালত ও প্রশাসন বারবার বাজি পোড়ানোয় নিয়ন্ত্রণ আনছে। অথচ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ বলছে, আসল দীপাবলি ছিল আলো আর প্রদীপের উৎসব—যেখানে বাজির কোনও স্থানই ছিল না।

বাজি আসলে ঐতিহ্য নয়, বরং পরবর্তীতে রাজকীয় উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এক সাংস্কৃতিক আমদানি—এই দাবি ঘিরেই এখন শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। তবে একথা অস্বীকার করা যায় না যে, আজকের প্রজন্মের কাছে বাজি মানেই দীপাবলির অবিচ্ছেদ্য আনন্দ। প্রশ্ন উঠছে—আমরা কি আসল ঐতিহ্য ভুলে যাচ্ছি?