কলকাতা, ৩ ডিসেম্বর: দীর্ঘ দুই বছর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে থাকা প্রায় ৩২ হাজার প্রাইমারি (Calcutta High Court TET) শিক্ষক আজ যেন নতুন করে আলো দেখলেন। কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দিয়েছে এই বিপুল সংখ্যক প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরি বহাল থাকবে।
বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও বিচারপতি ঋতব্রত কুমারের বেঞ্চ দুপুর ২টোর পর ইতিহাসগড়া সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আদালতের এই রায় শুধু আইনি নয়—এটি হাজার হাজার পরিবারে স্বস্তি, চোখের জলে ভেজা হাসি এবং দীর্ঘ সংগ্রামের মানসিক মুক্তি।
২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। মোট ১.২৫ লক্ষ পরীক্ষার্থী টেট পাস করলেও, নিয়োগ পায় ৪২,৯৪৯ জন। অভিযোগ ওঠে এদের মধ্যে ৩২,০০০ প্রার্থী নাকি নিয়মবহির্ভূতভাবে, সঠিক ইন্টারভিউ ছাড়াই এবং প্রশিক্ষণ ছাড়াই চাকরিতে ঢুকে গেছেন। ২০২৩ সালে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দিলে হাজার হাজার স্কুলশিক্ষকের পরিবারে নেমে আসে ভয়, আতঙ্ক এবং ভবিষ্যতের অন্ধকার।
SSC গ্রুপ-সি-গ্রুপ-ডি: ‘নিষ্কলঙ্ক’ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশে নির্দেশ বিচারপতি সিনহার
নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্যের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা দপ্তর আলোচনায় এসেছে গত তিন বছরে। চাকরি বাতিল হলে শুধু শিক্ষকই নন—অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, তাদের পড়াশোনা, পরিবারের উপার্জন—সব কিছুই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত। তাই ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানি চলাকালীন প্রতিটি দিনই ছিল টালমাটাল অপেক্ষা।
১২ নভেম্বর ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয়। এরপর পুরো রাজ্য অপেক্ষা করছিল আজকের রায়ের কথাই। আদালত আজ জানিয়ে দিল ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল হবে না। অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে পাঠদান চালিয়ে যেতে পারবেন তাঁরা। এই সিদ্ধান্তের পর শিক্ষকদের মধ্যে দেখা যায় স্বস্তির ঢেউ। কেউ চোখ মুছছেন, কেউ ফোনে পরিবারকে জানাচ্ছেন, আবার কেউ আদালতের বাইরে দাঁড়িয়েই বলছেন “আমাদের লড়াই বিফলে গেল না।”
আইনজীবীদের মতে, এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ একদিকে নিয়োগের সময়কার প্রশাসনিক ভুল ও দুর্নীতির অভিযোগ সত্যিই গুরুতর ছিল, অন্যদিকে এতো মানুষের ভবিষ্যৎকে এক ধাক্কায় ধ্বংস করা উচিত হবে কি না তা নিয়ে আদালতকে ভারসাম্য রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তাই আদালত রায় দেওয়ার সময় জোর দিয়েছে প্রশিক্ষণের অভাব বা ইন্টারভিউর ত্রুটি থাকলেও, যারা বছর বছর ধরে পড়াচ্ছেন, তাঁদের হঠাৎ ছাঁটাই করলে শিক্ষা ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটতে পারে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠনগুলিও বলছে এটি শুধু আইনগত লড়াই নয়; এটি সম্মান, অস্তিত্ব ও মর্যাদার লড়াই ছিল। বেতনহীনতা, সামাজিক লজ্জা, পরিবারে মানসিক চাপ সবকিছু মিলিয়ে গত দু’বছর ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। আজকের রায় তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বস্তি। যদিও মামলাকারীদের পক্ষের আইনজীবীরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছেন। ফলে লড়াই এখানেই শেষ নয়। তবুও আজকের রায় শিক্ষকদের জীবনে এক বিরাট পুনরুদ্ধার।
রাষ্ট্রশক্তি, রাজনৈতিক উত্তাপ, দুর্নীতি অভিযোগ এবং যোগ্যতার প্রশ্নে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার এক জটিল অধ্যায়ে এই রায় একটি নতুন বার্তা দিল মানুষের জীবিকার প্রশ্নে সংবেদনশীলতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেতে পারে। এখন দেখার বিষয় এই রায়ের পর সরকার কি নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া ও ইন্টারভিউ পদ্ধতি সংস্কারের পথে এগোয়, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতি আর না ফেরে।
