পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপাইবাজারে অবস্থিত বিজেপির জেলা কার্যালয়ে বুধবার তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) দিঘার জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপচারিতার জেরে বিজেপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। এই ক্ষোভ শুধু দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জেলা সভাপতি শমিত মন্ডলের বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশ পায়। বৃহস্পতিবার বিকেলে শমিত মন্ডল জেলা কার্যালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, যা শেষ পর্যন্ত হামলা ও ভাঙচুরে রূপ নেয়।
কী ঘটেছিল?
গত বুধবার দিঘার জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দিলীপ ঘোষের উপস্থিতি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সৌজন্যমূলক কথোপকথনের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এই ঘটনা বিজেপির স্থানীয় কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। বুধবার রাত থেকেই মেদিনীপুরের জেলা কার্যালয়ে দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। কর্মীরা তাঁর ছবিতে জুতোর মালা পরিয়ে এবং কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে প্রতিবাদ জানায়। এই ক্ষোভের আগুন বৃহস্পতিবার আরও তীব্র হয়, যখন জেলা সভাপতি শমিত মন্ডল তাঁর অনুগামীদের নিয়ে কার্যালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেন।
স্থানীয় বিজেপি কর্মীরা, বিশেষত যুব মোর্চার সদস্যরা, শমিত মন্ডলকে কার্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেয়। এরপর পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। বিক্ষোভকারীরা শমিত মন্ডল ও তাঁর অনুগামীদের উপর হামলা চালায় এবং তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করে। ভয়ে শমিত মন্ডল ও তাঁর সঙ্গীরা কার্যত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত জেলা যুব মোর্চার সহ-সভাপতি সুজয় দাস বলেন, “আমাদের রক্তে-শিরায় বিজেপির বীজ বপন করা। দিলীপ ঘোষ কীভাবে হরিদাস পালের মতো আচরণ করতে পারেন? তিনি মোদি হাওয়ায় এসে খড়্গপুরে কর্মীদের পরিশ্রমে জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল তিনি যা করলেন, তাতে মেদিনীপুরের মাটিতে তাঁর আর স্থান নেই।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, শমিত মন্ডল সিপিএম-এর স্টাইলে বিভিন্ন মন্ডল থেকে লোক নিয়ে কার্যালয় পরিচালনা করতে চান, যা তারা মেনে নেবেন না।
শুভেন্দু অধিকারীর প্রভাব
বিক্ষোভকারীদের বক্তব্যে শুভেন্দু অধিকারীর প্রতি সমর্থন স্পষ্ট। সুজয় দাস বলেন, “শুভেন্দু অধিকারী যেভাবে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তার জন্য আমরা তাঁকে স্যালুট জানাই।” রাজনৈতিক মহলের মতে, এই বিক্ষোভে শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামীদের হাত রয়েছে। দিলীপ ঘোষের সঙ্গে শুভেন্দুর দীর্ঘদিনের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে এসেছে। বিজেপির অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, দিলীপ ঘোষের প্রভাব কমে যাওয়ার পর মেদিনীপুরে শুভেন্দু শিবিরের প্রভাব বেড়েছে। শমিত মন্ডলকে দিলীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখা হয়, এবং তাঁর বিরুদ্ধে হামলা শুভেন্দু শিবিরের প্রভাব বজায় রাখার কৌশল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
দিলীপ ঘোষ ও শমিত মন্ডলের অবস্থান
এই ঘটনায় শমিত মন্ডলের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে দিলীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, তিনি মন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভক্তিভরে অংশ নিয়েছিলেন, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি বর্তমানে দলের কোনও পদে নেই এবং ত্রিপুরায় দায়িত্ব পালন করছেন। তবে, তাঁর স্ত্রী রিঙ্কু মজুমদার কোলাঘাটে বিক্ষোভের সময় বলেছিলেন, “দলে তিনটি লাইন চলছে,” যা দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদের ইঙ্গিত দেয়।
রাজনৈতিক প্রভাব
এই ঘটনা বিজেপির অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে এনেছে। একদিকে দিলীপ ঘোষের পুরনো কর্মীরা এখনও তাঁর প্রতি আনুগত্য দেখালেও, শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে নতুন শিবির মেদিনীপুরে প্রভাব বিস্তার করছে। তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনাকে হাতিয়ার করে বিজেপির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকে তুলে ধরেছে। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, “দিলীপ ঘোষ ভক্তিভরে মন্দিরে গিয়েছিলেন, এটা রাজনীতি নয়। কিন্তু বিজেপির কর্মীরা তাঁকে জুতোর মালা পরাচ্ছে। এতে বিজেপির মেকি হিন্দুত্ব উন্মোচিত হয়েছে।”
মেদিনীপুরে বিজেপির জেলা কার্যালয়ে এই হামলা ও বিক্ষোভ শুধু দিলীপ ঘোষ বা শমিত মন্ডলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রকাশ নয়, এটি দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ের একটি চিত্র। একদা মেদিনীপুরের ‘দুর্গ’ গড়ে তোলা দিলীপ ঘোষ এখন নিজের দলেরই বিক্ষোভের মুখে। এই ঘটনা বঙ্গ রাজনীতিতে নতুন জল্পনার জন্ম দিয়েছে এবং বিজেপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে প্রকাশ্যে এনেছে। আগামী দিনে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কীভাবে দলের কৌশলকে প্রভাবিত করে, তা রাজনৈতিক মহলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।