মুর্শিদাবাদে হিংসার জেরে শত শত মানুষ ভাগীরথী নদী পেরিয়ে মালদার আশ্রয়ে

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় হিংসার (Murshidabad Violence) জেরে শত শত মানুষ ভাগীরথী নদী পেরিয়ে পাশের মালদা জেলায় আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ওয়াকফ (সংশোধনী)…

Hundreds Flee Violence in Murshidabad, Seek Refuge in Malda Amid Rising Tensions"

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় হিংসার (Murshidabad Violence) জেরে শত শত মানুষ ভাগীরথী নদী পেরিয়ে পাশের মালদা জেলায় আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫-এর বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদের সুতি, ধুলিয়ান, জঙ্গিপুর এবং শামশেরগঞ্জের মতো মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় বিক্ষোভ গোষ্ঠী হিংসায় রূপ নিয়েছে, যার ফলে এই ব্যাপক পলায়ন ঘটেছে। স্থানীয় প্রশাসন পলায়নকারী পরিবারগুলোর জন্য স্কুলে থাকার এবং খাবারের ব্যবস্থা করেছে। নদীর তীরে স্বেচ্ছাসেবকদের মোতায়েন করা হয়েছে নৌকায় আগতদের সাহায্য করার জন্য।

Murshidabad  হিংসার ভয়াবহ চিত্র

মিডিয়ায় প্রকাশিত দৃশ্যে মুর্শিদাবাদের এই এলাকাগুলোতে পোড়া দোকান, হোটেল এবং বাড়িঘরের চিত্র দেখা গেছে। ধুলিয়ানের মন্দিরপাড়ার এক তরুণী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “আমাদের বাড়িঘর আগুন দেওয়া হয়েছে। মহিলা ও কন্যাসন্তানদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। বাইরের কিছু লোক এবং স্থানীয় কয়েকজনের দল এই হামলা চালিয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “তারা বোমা নিক্ষেপ করেছে, ওয়াকফ আইনের জন্য আমাদের দায়ী করে তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছাড়তে বলেছে। পুরুষদের উপর হামলা করা হয়েছে। আমরা প্রাণের ভয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্যে পালিয়ে আসি।”

অপর এক বয়স্ক মহিলা জানান, “আমরা হাত জোড় করে হামলাকারীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম, যদিও আমরা কোনও অন্যায় করিনি। তারা অস্ত্র নিয়ে এত অত্যাচার করেছে। আমি, আমার ছেলে, পুত্রবধূ এবং নাতির সঙ্গে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে আসি। নইলে আমাদের হত্যা করা হতো।” এই হিংসায় ধুলিয়ান থেকে ৪০০-এর বেশি মানুষ পালিয়েছে বলে দাবি করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।

শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ

শুভেন্দু অধিকারী এক্স-এ এক পোস্টে বলেন, “ধুলিয়ানের ৪০০-এর বেশি হিন্দু ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ভয়ে ভাগীরথী নদী পেরিয়ে মালদার বৈষ্ণবনগরের পার লালপুর হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলায় ধর্মীয় নিপীড়ন সত্যি। তৃণমূলের তুষ্টিকরণের রাজনীতি উগ্র মৌলবাদীদের উৎসাহিত করেছে। হিন্দুরা তাদের নিজের ভূমিতে জীবনের জন্য দৌড়াচ্ছে। রাজ্য সরকারের এই আইনশৃঙ্খলা ভাঙনের জন্য লজ্জা। আমি কেন্দ্রীয় বাহিনী, রাজ্য পুলিশ এবং জেলা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি, এই বাস্তুচ্যুতদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন এবং জীবন রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে।”

মালদায় আশ্রয় ব্যবস্থা

মালদার দেওনাপুর-সোবাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সুলেখা চৌধুরী জানিয়েছেন, শুক্রবার দুপুর থেকে মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং শনিবার রাত পর্যন্ত ৫০০-এর বেশি এলাকা ছেড়েছেন৷ তিনি জানিয়েছেন, “শুক্রবার দুপুর থেকে নৌকায় করে মানুষ আসতে শুরু করে এবং শনিবার রাত পর্যন্ত ৫০০-এর বেশি মানুষ এসেছে, যাদের বেশিরভাগই মহিলা।” তিনি আরও বলেন, এই মানুষদের স্থানীয় স্কুলে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কালিয়াচক ৩ ব্লকের ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার (বিডিও) সুকান্ত শিকদার জানান, শনিবার দুপুর পর্যন্ত মানুষের আগমন সীমিত ছিল, তবে পরে সংখ্যা বেড়েছে।

Advertisements

তৃণমূল কংগ্রেসের বৈষ্ণবনগরের বিধায়ক চন্দনা সরকার জানান, নদীর তীরে ২০ জন যুবককে মোতায়েন করা হয়েছে মুর্শিদাবাদ থেকে নৌকায় আগতদের সাহায্য করার জন্য। তিনি বলেন, “আমরা তাদের স্কুলে আশ্রয় দিয়েছি এবং সব ব্যবস্থা করেছি।” মালদার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধি জানান, শনিবার থেকে ধুলিয়ান, সুতি এবং জঙ্গিপুর থেকে ৪০-৫০টি নৌকায় দাঙ্গাপীড়িত মানুষ এসেছে। এদের জন্য কালিয়াচক ৩ ব্লকের পাল্লারপুর গ্রামে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে।

হিংসার পটভূমি

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫, গত ৮ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। এই আইনের বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদে শুক্রবার থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়, যা দ্রুত হিংসায় রূপ নেয়। পুলিশ জানিয়েছে, এই হিংসায় তিনজন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে এক পিতা-পুত্র রয়েছেন। শামশেরগঞ্জের জাফরাবাদে হরগোবিন্দ দাস (৭২) এবং তাঁর ছেলে চন্দন দাসের (৪০) ছুরিকাঘাতে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া, ১৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় নিষেধাজ্ঞা ও ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

হিংসার জেরে রাজনৈতিক উত্তেজনাও তুঙ্গে। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ খলিলুর রহমান দাবি করেছেন, হিংসার জন্য বাইরের লোকজন দায়ী। তবে তিনি তাদের উৎস সম্পর্কে কিছু জানেন না। অন্যদিকে, বিজেপি নেতারা তৃণমূলের ‘তুষ্টিকরণের রাজনীতি’কে দায়ী করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, এই আইন বাংলায় কার্যকর হবে না। কলকাতা হাইকোর্ট শনিবার মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে, রাজ্য সরকারের ব্যবস্থাকে অপর্যাপ্ত বলে।

মুর্শিদাবাদের এই হিংসা ও পলায়ন ভারতীয় সমাজের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পলায়নকারীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন এবং শান্তি ফিরিয়ে আনা এখন প্রশাসনের প্রধান দায়িত্ব। তবে, রাজনৈতিক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা রোধ করতে স্বচ্ছ তদন্ত এবং কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।