সমাজকে স্তম্ভিত করে দেওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনা সামনে এল হাওড়া (Howrah) জেলার ঘুসুরি এলাকা থেকে। মালিপাঁচঘোরা থানার অন্তর্গত এই এলাকায় বছর কুড়ির এক যুবতীকে পনেরো দিন ধরে শিকলে বেঁধে নিজের ঘরেই আটকে রাখলেন তার মা-বাবা। মেয়ের জীবনযাপন নিয়ে সন্দেহ থেকেই এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে দাবি পরিবার সূত্রে।
এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রকাশ্যে আসে এক আবাসনের যুবকের চোখে পড়ার পর। প্রতিবেশীর নজরে আসে, ওই যুবতী দীর্ঘদিন ঘরেই বন্দি, এবং সন্দেহজনকভাবে ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় তার পায়ে শিকল বাঁধা। খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকা জুড়ে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়রা পুলিশে খবর দিলে, মালিপাঁচঘোরা থানার পুলিশ এসে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে শিকল খুলে মুক্ত করেন ওই যুবতীকে।
যুবতীর কথায় উঠে আসে আরও ভয়াবহ তথ্য। তার দাবি, সে পড়াশোনা করে চাকরি করতে চায়, নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু মা-বাবা জোর করে বিয়ে দিতে চাইছেন। এই বিষয়েই মতবিরোধ চরমে ওঠে এবং এরপরেই তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। “১৫ দিন ধরে ঘরেই আটকে রাখা হয়েছে। মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কাউকে জানাতে পারিনি। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিলো, যেন বাইরে যেতে না পারি,” কান্নাজড়িত গলায় বলেছে ওই যুবতী।
অন্যদিকে, যুবতীর মা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, “আমাদের সন্দেহ হচ্ছিল ও কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে দেখা করছে, ঠিকঠাক বলছে না। বারবার জিজ্ঞেস করেও কিছু জানাতে চাইছিল না। তাই বাধ্য হয়ে আটকে রাখতে হয়েছে।”
তবে এই বক্তব্য মানতে নারাজ স্থানীয় মানুষজন এবং সমাজকর্মীরা। তাঁদের মতে, নিজের সন্তানকে এভাবে শিকল দিয়ে আটকে রাখার অধিকার কারোরই নেই। এটি একটি স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, যুবতীর মা-বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং পুরো ঘটনার তদন্ত চলছে। পাশাপাশি, যুবতীর নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে প্রশাসনিক স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
যুবতী বর্তমানে পুলিশের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন এবং মনোসমস্যা বা মানসিক চাপে ভুগছেন কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই ঘটনায় মনোবিদদের পরামর্শ নেওয়ার কথাও ভাবছে প্রশাসন।
স্থানীয় এক সমাজকর্মী বলেন, “মেয়েদের স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতা নিয়ে এখনও বহু পরিবারে সংকীর্ণ মানসিকতা বিরাজ করছে। এই ঘটনা তার প্রমাণ। মেয়েটি যদি নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তবে তাকে সেই অধিকার দেওয়াই উচিত।”
ঘটনার পর এলাকাজুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে সন্তানদের স্বাধীনতা, পিতামাতার দায়িত্ব এবং পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। বিশেষ করে কন্যাসন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনও সমাজের বড় অংশের দৃষ্টিভঙ্গি যে কতটা পুরনো, এই ঘটনাই তার বহিঃপ্রকাশ।
এই মুহূর্তে পুলিশ গোটা ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করেছে। যুবতীর অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তার ভবিষ্যৎ যেন সুরক্ষিত থাকে, সে জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সমাজের চোখে এক গভীর প্রশ্ন রেখে গেল এই ঘটনা—নিজের ইচ্ছায় জীবন গড়ার চেষ্টাকে কি এমনভাবে শিকলবন্দি করা যায়?