উত্তর ২৪ পরগনার হাকিমপুর বিএসএফ আউটপোস্টের কাছে সরু কাঁচা পথের ধারে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এক অস্বাভাবিক ভিড় দেখা যাচ্ছে। বিশাল বটগাছের নিচে ছোট ব্যাগ হাতে পরিবার, শিশুদের হাতে বোতল, আর পুরুষেরা গুটিশুটি মেরে বসে—সবাইয়ের একই অনুরোধ, “আমাদের বাড়ি যেতে দিন।”
নভেম্বরের শুরু থেকে পশ্চিমবঙ্গে বহু বছর ধরে বসবাস করা নথিহীন বাংলাদেশি নাগরিকরা হঠাৎ করেই নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন। বিএসএফ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বিশেষ ভোটার তালিকা পুনর্বিবেচনা (Special Intensive Revision—SIR) শুরু হওয়ার পর থেকেই এই উল্টো অভিবাসনের ঢেউ তৈরি হয়েছে।
SIR যাচাইকরণে বাড়ছে উদ্বেগ:
খুলনার বাসিন্দা পরিচয় দেওয়া শাহিন বিবি, যিনি নিউ টাউনে গৃহকর্মী ছিলেন, কোলে সন্তান নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, “আমার কাছে ঠিকঠাক নথি নেই। এখন যাচাইকরণ শুরু হয়েছে, তাই দেশে ফিরে যেতে চাই।” মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করতেন তিনি, কিন্তু নথিহীনতার ভয়ে থাকার সাহস পাচ্ছেন না।
সারিতে দাঁড়ানো বহু মানুষ জানিয়েছেন, দালালদের মাধ্যমে আধার, রেশন কার্ড বা ভোটার আইডি সংগ্রহ করেছিলেন তারা। SIR-এ পুরনো কাগজপত্র যাচাই বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনেকেই জিজ্ঞাসাবাদ বা আটক হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে দেশে ফিরছেন।
প্রতিদিন ১৫০–২০০ জন আটক, সীমান্তে তীব্র চাপ:
বিএসএফ জানিয়েছে, প্রতিদিন ১৫০–২০০ জনকে আটক করে যাচাইয়ের পর ফেরত পাঠানো হচ্ছে। নভেম্বর ৪ থেকে সারির চাপ দ্রুত বাড়ছে।
বায়োমেট্রিক সংগ্রহ করে জেলা প্রশাসন ও রাজ্য পুলিশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়, যার ফলে দু’তিন দিন পর্যন্ত দেরি হচ্ছে।
অপেক্ষমাণ মানুষরা ট্রাকের নিচে, খোলা মাঠে বা প্লাস্টিকের উপর রাত কাটাচ্ছেন। বিএসএফ ক্যাম্পের ভেতরে থাকা মানুষদের খাবার দেওয়া হলেও বাইরে অপেক্ষা করা লোকজন দোকান বা স্থানীয়দের সাহায্যের ওপর নির্ভর করছেন।
দালালের মাধ্যমে প্রবেশ, এখন ফিরতে বাধ্য:
অনেকেই স্বীকার করেছেন, ৫,০০০ থেকে ৭,০০০ টাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন; কেউ কেউ আবার ২০ হাজার টাকায় নথি বানানোর কথাও বলেছেন।
ধূলাগুড়ির পোশাক কারখানায় কাজ করা মনিরুল শেখ বলেন, “সবাই জানত কোন দালালের কাছে যেতে হবে। কিন্তু SIR এসে সব ঠিকঠাক নথি চাইছে—তাই সবাই ফিরছে।”
এক যুবক বলেন, “২০১৬, ২০১৯, ২০২১, ২০২৪—সব বছর ভোট দিয়েছি। কিন্তু ২০০২-এর কাগজ দেখাতে পারব না। তাই চলে যাচ্ছি।”
স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর বাড়ছে চাপ:
এক পুলিশ অফিসার জানান, “দুই দিনে ৯৫ জনকে আটক করেছি। থানায় রাখার জায়গা নেই। পরে আর হেফাজত নেওয়া যায়নি।”
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চান—রাজনৈতিক টানাপোড়েন যতই চলুক, সীমান্তে এই মানবিক সংকট যেন দ্রুত কমে।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশে ফেরা:
গত ছয় দিনে প্রায় ১,২০০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে বিএসএফ সূত্রের দাবি। শনিবারও ৬০ জন অপেক্ষা করছিলেন।
এক অন্ধপ্রায় বৃদ্ধ বলেন, “১৮ বছর আগে চিকিৎসার জন্য এসেছিলাম, পরে ট্রেনে গান গেয়ে খেতাম। এখন জানি না, এত বছর পরে বাংলাদেশ আমাকে নেবে কি না।”
সূর্য অস্তলে যেতে যেতে কাঁটাতারের পাশে লম্বা লাইনটা আরও বাড়তে থাকে।
বিএসএফের এক জওয়ান বললেন, “এরা অন্ধকারে এসেছিল। এখন দিনের আলোয় ফিরছে—এটাই পার্থক্য।”
SIR এখন আর শুধু প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়, বহু পরিবারের জন্য এটি একটি অনিশ্চিত ঘরে ফেরার শেষ ধাক্কা।
