ঘাটালে ফের বন্যার (Ghatal Flood Tragedy) বলি হলেন এক পরিবহণ কর্মী। চতুর্দিক জলমগ্ন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছিলেন রাজীব সিংহ রায় (বয়স প্রায় ৪৫), ঘাটালের শ্যামপুর এলাকার অজবনগর গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় তিনি স্থানীয় একটি পরিবহণ সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। প্রতিদিনের মতো এদিনও কাজ সেরে দেরিতে ফিরছিলেন, কিন্তু প্লাবিত রাস্তায় চলাচল ছিল কঠিন। মাঝপথে হঠাৎ বন্যার জলে তলিয়ে যান তিনি। পরিবারের দাবি, সাঁতার না জানায় ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর।
ঘটনার পরপরই পরিবারের সদস্যরা এনডিআরএফ-কে খবর দেন। রাতভর খোঁজাখুঁজি চলে, কিন্তু রাজীবকে পাওয়া যায়নি। শুক্রবার সকালে শ্যামপুর এলাকায় তাঁর দেহ ভেসে ওঠে। পরিবারের লোকজন দেহ শনাক্ত করেন এবং পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়। এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতিকে আরও তীব্রভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
বর্ষা শুরু হতেই ঘাটাল পুরসভার ১২টি ওয়ার্ড এবং একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েত প্লাবিত হয়েছে। এলাকার বাসিন্দারা বছরের পর বছর ধরে বন্যা সমস্যায় ভুগছেন। শীলাবতী, কংসাবতী এবং দ্বারকেশ্বর নদীর শাখা ঝুমি নদীর তীরবর্তী এই এলাকা বরাবরই বন্যা প্রবণ। ইতিহাস বলছে, জমিদারি আমলে স্থানীয় ভূস্বামীরা ‘সার্কিট বাঁধ’ নির্মাণ করেছিলেন নিম্নাঞ্চলকে বন্যা থেকে বাঁচাতে এবং আবাদি জমি বাড়াতে। কিন্তু আজ সেই জমিদারি নেই, বাঁধ রয়েছে—তবে সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ নেই বললেই চলে। ফলে প্রতিবছরই ভঙ্গুর বাঁধ ভেঙে বন্যা আছড়ে পড়ে ঘাটালে।
শুধু বাঁধ ভাঙাই নয়, জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি নদীর তীরে জমে নদীর জলধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে পড়ে, প্লাবিত হয় গ্রাম ও শহরের একাধিক এলাকা। এই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বহু বছর আগে প্রস্তাবিত হয়েছিল ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’। কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থ বরাদ্দের অভাবে প্রকল্পটি দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরামবাগে সাংসদ দেবকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, কেন্দ্র না দিলেও রাজ্য সরকার ১,২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। দেবের ‘আবদার’ মেনে তিনি এই আশ্বাস দেন। সেই অনুযায়ী কিছু ধাপের কাজ শুরু হলেও, এখনও পুরো প্রকল্প শেষ হয়নি। ফলে এ বছরও ঘাটালবাসীকে একই দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান সম্পূর্ণ হলে শহর ও আশপাশের গ্রামগুলিকে বার্ষিক বন্যার হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নদীর পলি অপসারণ, বাঁধ মেরামত, এবং জলনিকাশ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু ধীরগতির কাজ ও বর্ষার তীব্রতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
নিহত রাজীব সিংহ রায়ের পরিবারের সদস্যরা প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের কথায়, “যদি আগে থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকত, আর রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচলের মতো ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো ওর মৃত্যু হত না।” স্থানীয়দের মতে, শুধু ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযান যথেষ্ট নয়, বরং ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান দ্রুত শেষ করাই হবে এই অঞ্চলের স্থায়ী সমাধান।
এই ঘটনার পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—ঘাটালবাসীকে আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে বন্যামুক্ত জীবনের জন্য? প্রশাসনিক আশ্বাস আর ঘোষণার ফাঁকে, রাজীবের মতো আরও কতজন প্রাণ হারাবেন, সেই উত্তর এখনো অজানা।