ডিভিসির সঙ্গে রাজ্যের লড়াই, শীতের মরশুমে রবি চাষে জল না পেয়ে ক্ষতির মুখে পঁচিশ লক্ষ কৃষক

রাজ্যের (West Bengal) কৃষকদের (farmers) কাছে এবারের শীতকাল যেন এক অজানা দুঃস্বপ্ন। সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ গল্পের মতোই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বাঁকুড়ার বোরো চাষিদের মধ্যে।…

DVC water

রাজ্যের (West Bengal) কৃষকদের (farmers) কাছে এবারের শীতকাল যেন এক অজানা দুঃস্বপ্ন। সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ গল্পের মতোই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বাঁকুড়ার বোরো চাষিদের মধ্যে। তাদের নাকের জল আর চোখের জল, কিন্তু কপালে আরও বড় দুশ্চিন্তা – জল সংকট! এই জল সংকটের কারণ, রাজ্য সরকার এবং দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (DVC) -এর মধ্যে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের চিড়। বিশেষত বর্ষাকালে দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ানোর ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সঙ্গে ডিভিসির (DVC) বিরোধ অনেকটাই গভীর হয়ে গেছে, যার প্রভাব এখন শীতকালীন রবি চাষের উপর পড়তে চলেছে।

বোরো চাষে বাঁকুড়া জেলার কৃষকরা যা বেশিরভাগ সেচের জল পায় ডিভিসির (DVC) দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে, সেখানেই সমস্যার সৃষ্টি। রাজ্য সরকারের সঙ্গে ডিভিসির সম্পর্কের তিক্ততা এবং জল ছাড়ানোর জন্য রাজ্যের কোনো আবেদন না করা, বর্তমানে কৃষকদের সামনে চরম সংকট তৈরি করেছে। তারা এখন অপেক্ষা করছেন জানার জন্য, যদি সেচের জল না মেলে, তাদের আগামী দিন কিভাবে কাটবে।

   

ডিভিসি-রাজ্য সংঘাতের সূত্রপাত:
ডিভিসি (DVC) ও রাজ্য সরকারের সম্পর্কের সমস্যা নতুন নয়। বর্ষাকালে রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন, ডিভিসি অযথা অতিরিক্ত জল ছাড়ে, যার ফলস্বরূপ রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশ বন্যায় প্লাবিত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির পর মুখ্যমন্ত্রী ডিভিসির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা করেছিলেন এবং বাংলার দুই প্রতিনিধি ডিভিসির কার্যক্রম থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারও ডিভিসির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, রাজ্য সরকার তাদের বিরোধী অবস্থান নেন, যার প্রভাব এখন শীতকালীন সেচ ব্যবস্থায় পড়েছে।

বাঁকুড়ার কৃষকরা কি সংকটের মধ্যে?
বাঁকুড়ার কৃষকরা ইতিমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন বোরো চাষের জন্য। বীজতলা তৈরি হলেও জমি তৈরির কাজ শুরু হয়নি। কারণ তারা জানেন, সেচের জল না পেলে এই জমিগুলিতে চাষ করা সম্ভব নয়। বাঁকুড়া জেলায় প্রায় ৬৬,৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়, যার মধ্যে ১৫,২৫০ হেক্টর জমি ডিভিসির দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে সেচের জল পেয়ে চাষ করা হয়। বাঁকুড়া জেলার বড়জোড়া, সোনামুখী, পাত্রসায়ের, এবং ইন্দাস ব্লকগুলির কৃষকরা একমাত্র দুর্গাপুর ব্যারেজের জলেই নির্ভরশীল। যদি তারা এই জল না পায়, তাহলে প্রায় ১৫,২৫০ হেক্টর জমি অনাবাদি হয়ে যাবে।

কৃষকরা কী বলছেন?
হারাধন বাগ্দী, একজন স্থানীয় কৃষক বলেন, “এই জলের ওপর আমাদের চাষ নির্ভর করে। যদি এই জল না পাই, তাহলে আমাদের কাছে কোনো উপায় থাকবে না। আমরা খেতমজুর, আর এই বোরো চাষের ওপরেই আমাদের জীবিকা চলে। ডিভিসি যদি জল না ছাড়ে, তবে আমাদের পক্ষে কোনোরকম জীবনযাপন করা সম্ভব হবে না।”

এমনটাই মনে করছেন বাঁকুড়া জেলার অন্য কৃষকরাও। তারা জানাচ্ছেন, সেচের জল না পেলে তাদের কোনো উপায় থাকবে না, কারণ এই সময় জল না পেলে পুরো মরশুমটাই নষ্ট হয়ে যাবে। ফলস্বরূপ, তাদের সামনে হয়তো বিরাট ক্ষতি আসতে চলেছে।

বিজেপি নেতার অভিযোগঃ
বিজেপি সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ১ ডিসেম্বর থেকে রাজ্য সরকারের ডিভিসির সঙ্গে আলোচনা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এবছর এখনও পর্যন্ত সেচের জল নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আবেদন জমা দেওয়া হয়নি। বিজেপি নেতার অভিযোগ, রাজ্য সরকার সেচের জন্য কোনো ব্যবস্থা করেনি, ফলে কৃষকরা বিপদে পড়েছেন।

কৃষকদের হতাশা এবং আশাঃ
এখন বাঁকুড়ার কৃষকরা দিন কাটাচ্ছেন আশা এবং আশঙ্কার দোলাচলে। তারা জানেন, এই সেচের জল ছাড়া হলে তাদের চাষের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। কৃষকদের মতে, ডিভিসি যদি জল না ছাড়ে, তবে কৃষকদের মুখে অন্ন হবে না। একদিকে শীতকাল, অন্যদিকে জল না পাওয়ার ভয়। এই দুশ্চিন্তা তাদের পিছু ছাড়ছে না।

অগ্রসর হওয়া উচিত কি?
এখন প্রশ্ন উঠছে, কি করা উচিত? রাজ্য সরকার এবং ডিভিসির (DVC) মধ্যে শীঘ্রই আলোচনা শুরু হওয়া প্রয়োজন। এই সংকট কাটানোর জন্য কৃষকদের সমস্যা সমাধানে একটি সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায়, জল সংকটের কারণে বাঁকুড়ার কৃষকদের ক্ষতি হয়ে যাবে এবং রাজ্যও এই সমস্যায় পড়বে। রাজ্য সরকার এবং ডিভিসি যদি দ্রুত এই বিষয়ে কোনো সমাধান না করে, তবে কৃষকদের জন্য পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

বাঁকুড়ার কৃষকরা এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের প্রায় ১৫,২৫০ হেক্টর জমি সেচের জল ছাড়া হলে অনাবাদি থাকবে। রাজ্য সরকার এবং ডিভিসির (DVC) মধ্যে দ্রুত আলোচনা হওয়া উচিত, যাতে শীতকালে এই জল সংকট সমাধান করা যায় এবং কৃষকরা তাদের বোরো চাষ করতে পারে। তাদের একমাত্র আশা, জল মিললে তাদের জীবন স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, আর না মিললে তাদের জন্য দুর্দিন অপেক্ষা করছে।