‘দালাল’ দিলীপকে জুতোর মালা পরিয়ে ক্ষোভ বিজেপি কর্মীদের

এক সময় মেদিনীপুর ছিল বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) অপ্রতিরোধ্য গড়। তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিম মেদিনীপুরে বিজেপি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলেছিল, যা রাজ্য রাজনীতিতে দলের…

Dilip Ghosh Faces Backlash in Medinipur

এক সময় মেদিনীপুর ছিল বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) অপ্রতিরোধ্য গড়। তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিম মেদিনীপুরে বিজেপি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলেছিল, যা রাজ্য রাজনীতিতে দলের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল। কিন্তু গত বুধবার রাতে সেই মেদিনীপুরেই দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেন বিজেপিরই একাংশ কর্মী-সমর্থক। দিঘার জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দিলীপ ঘোষের উপস্থিতি এবং তাঁদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ কথোপকথনের ছবি প্রকাশ্যে আসার পরই বিজেপির জেলা কার্যালয়ে উত্তেজনা ছড়ায়। কর্মীরা দিলীপ ঘোষের ছবিতে জুতোর মালা পরিয়ে, কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে এবং তাঁকে ‘তৃণমূলের দালাল’ আখ্যা দিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান। এই ঘটনা বঙ্গ রাজনীতিতে নতুন জল্পনার জন্ম দিয়েছে।

দিঘার ঘটনা: কী ঘটেছিল?

বুধবার বিকেলে দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন দিলীপ ঘোষ। এই অনুষ্ঠানে তাঁদের মধ্যে সৌজন্যমূলক কথোপকথনের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই বিজেপি শিবিরে অস্বস্তি শুরু হয়। বিজেপির একাংশ নেতা-কর্মী এই ঘটনাকে দলের আদর্শের পরিপন্থী বলে মনে করছেন। তাঁদের বক্তব্য, দিলীপ ঘোষ দলের নির্দেশ অমান্য করে এই অনুষ্ঠানে গিয়েছেন এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ দলের কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এই ঘটনার পর রাত ১০টা নাগাদ মেদিনীপুর শহরের সিপাইবাজারে অবস্থিত বিজেপির জেলা কার্যালয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়।

   

বিক্ষোভের চিত্র: জুতোর মালা ও তালা

বিক্ষোভকারী বিজেপি কর্মীরা জেলা কার্যালয়ের মূল ফটকে দিলীপ ঘোষের ছবি টাঙিয়ে তাতে জুতোর মালা পরান। কেউ কেউ তাঁর ছবিতে জুতো মারতে শুরু করেন। কার্যালয়ের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এবং ‘দিলীপ ঘোষ মুর্দাবাদ’, ‘দিলীপ ঘোষকে দল থেকে বহিষ্কার করো’, ‘দিলীপ ঘোষের কালো হাত ভেঙে দাও’—এমন স্লোগানে মুখরিত হয় এলাকা। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, দিলীপ ঘোষ দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলের সঙ্গে ‘সেটিং’ করে কাজ করছেন। তাঁরা দাবি করেন, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন থেকেই দিলীপ ঘোষ নির্বাচনী কৌশলের নামে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়ে নেতা নিয়োগ করেছেন, যার ফলে বিজেপি বারবার ভরাডুবির মুখে পড়েছে। এক বিক্ষোভকারী বলেন, “দিলীপ ঘোষের এই আচরণ লজ্জাজনক। তিনি তৃণমূলের হয়ে কাজ করছেন, এটা আজ প্রমাণিত। আমরা তাঁর বহিষ্কার চাই।”

বিজেপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব: পুরনো বনাম নব্য

এই ঘটনাকে অনেকে বিজেপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের প্রকাশ হিসেবে দেখছেন। দলের পুরনো কর্মীদের সঙ্গে তৃণমূল থেকে আগত নব্য বিজেপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘাত দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই বিক্ষোভে শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামীদের হাত রয়েছে। শুভেন্দু বর্তমানে বঙ্গ বিজেপির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা এবং তাঁর সঙ্গে দিলীপ ঘোষের সম্পর্ক সবসময় মধুর ছিল না। দিলীপ ঘোষের দিঘা সফর এবং মমতার সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনা শুভেন্দু শিবিরের কাছে অস্বস্তিকর বলে মনে করা হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে বিজেপি সমর্থকদের একাংশও দিলীপের এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন। একজন সমর্থক লিখেছেন, “শুভেন্দু অধিকারী হিন্দুদের জন্য লড়াই করছেন, আর দিলীপ ঘোষ এসব নাটক করছেন। লজ্জার বিষয়!”

দিলীপ ঘোষের প্রতিক্রিয়া ও দলের অবস্থান

এই ঘটনা প্রসঙ্গে বিজেপির জেলা মুখপাত্র অরূপ দাস বলেন, “দিলীপ ঘোষের দিঘা সফর নিয়ে কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। তবে কার্যালয়ে ঠিক কী ঘটেছে, তা আমার পুরোপুরি জানা নেই। দল এ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে।” তিনি আরও জানান, পূর্ব মেদিনীপুরে দলের একটি অনুমোদিত অনুষ্ঠানে শুভেন্দু অধিকারী উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু দিলীপ ঘোষ সেখানে না গিয়ে জগন্নাথ মন্দিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যা অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত।

দিলীপ ঘোষ নিজে এ বিষয়ে সরাসরি কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে তিনি আগেই জানিয়েছিলেন যে, তিনি বর্তমানে দলের কোনও পদে নেই এবং ত্রিপুরায় কাজের দায়িত্ব পেয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, দিলীপ ঘোষ মন্দির উদ্বোধনে ভক্তি থেকেই গিয়েছিলেন, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।

তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনায় তৃণমূল কংগ্রেস তীব্র কটাক্ষ করেছে। তৃণমূলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা বলেন, “দিলীপ ঘোষকে বিজেপি হিন্দুত্বের পোস্টার বয় হিসেবে প্রচার করেছিল। কিন্তু তিনি মন্দির উদ্বোধনে গিয়েছেন বলে তাঁরই দল তাঁকে জুতোর মালা পরাচ্ছে। এতে বিজেপির মেকি হিন্দুত্বের মুখোশ খুলে গেছে।” তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ এই ঘটনাকে ‘ভক্তি’র বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “দিলীপ দা ভক্তিভরে পুজো করেছেন। এটা রাজনীতি নয়।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা বিজেপির অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রতিফলন। দিলীপ ঘোষের মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে বর্ধমান-দুর্গাপুরে প্রার্থী করা, লোকসভা নির্বাচনে তাঁর পরাজয় এবং দলের কোনও পদে না থাকার কারণে তাঁর প্রভাব কমে গেছে। মেদিনীপুরে তাঁর প্রাক্তন গড়েও এখন নতুন নেতৃত্বের উত্থান ঘটছে। এই ঘটনা দিলীপ ঘোষের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কেউ কেউ মনে করছেন, তিনি হয়তো দলের মধ্যে নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন, আবার কেউ বলছেন, এটি তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হতে পারে।

দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে মেদিনীপুরে বিজেপি কর্মীদের এই বিক্ষোভ কেবল একটি ঘটনা নয়, এটি দলের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা এবং নেতৃত্বের সংঘাতের একটি চিত্র তুলে ধরেছে। একদা দুর্দান্ত প্রতাপশালী নেতা হিসেবে পরিচিত দিলীপ ঘোষ কি সত্যিই তাঁর গড়ে ফিকে হয়ে যাচ্ছেন? নাকি এটি তাঁর নতুন রাজনৈতিক পদক্ষেপের সূচনা? এই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে। তবে এই ঘটনা বঙ্গ রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যা আগামী দিনে বিজেপির অভ্যন্তরীণ সমীকরণকে প্রভাবিত করতে পারে।