শান্তনু পান, পশ্চিম মেদিনীপুর: বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (Vidyasagar University) অধীন ইতিহাসের প্রশ্নপত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়া ঘিরে জোর বিতর্ক ছড়িয়েছে। স্নাতক স্তরের ষষ্ঠ সেমিস্টারের পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে— “মেদিনীপুরের তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর নাম লিখুন, যারা সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা নিহত হন।”
এই প্রশ্ন ঘিরেই শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। প্রশ্নপত্রে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বীর বিপ্লবীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, এমনটাই অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহলে। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে একাধিক বিপ্লবী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন মেদিনীপুরের তরুণরা।
ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডি— লবণ সত্যাগ্রহ দমন করতে গিয়ে, বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্ত ও জ্যোতিজীবন ঘোষের হাতে নিহত হন। এরপর আসেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস, যিনি হিজলি জেলে বন্দিদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন, শহিদ হন সন্তোষ মিত্র ও তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। পরে প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য ডগলাসকে হত্যা করেন।
এরপর তৃতীয় ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ, যিনি পুলিশ মাঠে ফুটবল ম্যাচ উদ্বোধনের সময়ে মৃগেন দত্ত ও রামকৃষ্ণ রায়ের গুলিতে নিহত হন। এই বিপ্লবীরা যে দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান দিয়েছেন, তাদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলায় বিস্ময় প্রকাশ করছেন ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, ‘প্রিন্টিং মিস্টেক’! বিতর্ক মাথাচাড়া দিতেই বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে বিশ্ববিদ্যালয়। রেজিস্ট্রার জয়ন্ত কিশোর নন্দী জানান, “প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি, এটি ছাপার ভুল। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপাচার্যের নির্দেশে বৃহস্পতিবার প্রথমার্ধেই রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।”
তবে একাধিক প্রাক্তন অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ প্রশ্ন তুলেছেন— এটা কী শুধুই ছাপার ভুল, নাকি এর পিছনে রয়েছে ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতির চেষ্টা? চন্দ্রকোণা রোড গৌরব গুইন মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আকবর আলি শাহ বলেন, “এই প্রশ্ন শুধুই ভুলে ভরা নয়, একই প্রশ্ন একাধিকবার এসেছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলা হয়েছে, এটা খুবই লজ্জার।”
তিনি আরও বলেন, “আমি জানি না বিশ্ববিদ্যালয় এখন কারা চালাচ্ছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এমন ভুল প্রশ্ন যাওয়া কখনোই মেনে নেওয়া যায় না।” বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনায় শিক্ষা মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে।
প্রশ্নপত্র তৈরির পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা ও ঐতিহাসিক বিষয়ের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিপ্লবীদের ইতিহাসকে অপমান করা চলবে না, এমন দাবিও তুলেছেন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস প্রশ্নপত্রে বিপ্লবীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়া নিঃসন্দেহে গুরুতর।
এটি শুধু একটি প্রশ্নপত্রের ভুল নয়, বরং দেশপ্রেম ও ইতিহাসচেতনার প্রতি অসচেতনতার নগ্ন প্রকাশ।
তদন্ত রিপোর্টের পর কী সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সেটাই এখন দেখার।