মিলন পণ্ডা, কাঁথি: কাঁথির পিছাবনি এলাকার নবম শ্রেণির ছাত্রের আত্মহত্যার (Student Suicide) ঘটনায় কার্যত নয়া মোড়। স্থানীয় মাতব্বর ও মেয়ের বাবা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ওই নবম শ্রেণির ছাত্রকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিল এমনই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে!
বন্ধু থেকে ও স্কুলের শিক্ষকের প্রতিক্রিয়ার পর এমনই প্রশ্ন উঠেছে। রাতভর অভিযান চালিয়ে তদন্ত নেমে কাঁথি থানার পুলিশ মেয়ে বাবা সহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। গত শুক্রবার সকালে কাঁথির পিছাবনি বাণী নিকেতন হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র সূর্য মান্না (১৫) বাড়ির দোতালায় কড়ি কাঠে লাইলন দড়ির ফাঁস অবস্থায় ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়।
ছাত্রটি সুইসাইড নোট লিখেই আত্মহত্যা করে। তাতেই ছাত্র লেখে, “বাবা আমি ভুল করিনি, ওই মেয়েটাকে আমি চিনি না৷’’ কাঁথি থানার পুলিশ মৃতদেহটি উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য কাঁথি মহকুমা হাসপাতালে পাঠান। গত ২৯ জুলাই মৃত ছাত্র সূর্য মান্নার বাবা রবীন্দ্রনাথ মান্না কাঁথি থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তারপরেই তদন্তে নেমে পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করে।
কাঁথি থানায় পুলিশ জানিয়েছে ধৃতরা হল মেয়ের বাবা রামনগর থানায় সাহাপুর অনুপ মণ্ডল, উওর শীতলা গ্রামের বুবু শ্যামল ও মানিকাবাসান গ্রামের সুদীপ্ত পণ্ডা। ঘটনার আরও এক অন্যতম অভিযুক্ত লালু শ্যামল পুলিশ আসার আগাম খবর পেয়ে বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়।
গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। এই মামলা তদন্তকারী পুলিশ অফিসার চন্দন মাইতি বলেন, “অভিযোগের ভিত্তিতে এখনও পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তের আগে কিছু বলা সম্ভব নয়৷”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে কাঁথির সুরাবনী গ্রামের নবম শ্রেণীর ছাত্র সূর্য মান্না সহ ৪ জন বন্ধু অপর এক বন্ধু যীশু বারুই বাড়িতে ইংরেজি বই আনতে গিয়েছিল। বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার সময় স্কুলের এক অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রীকে কটুক্তি করেছে এমন অভিযোগ তুলে পিছাবনী বাজারে ছাত্রীর বাবা সহ কয়েকজন তার বন্ধুরা চারজন ছাত্রকে আটকে রাখে।
প্রকাশ্য রাস্তায় মেয়ে বাবা অনুপ মণ্ডল, লালু শ্যামল, বুবু শ্যামল ও সুদীপ্ত পণ্ডা তাঁরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে বলে অভিযোগ। এই নির্যাতনের ফলে ছাত্র সূর্ষ মান্না মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। পরের দিন অর্থাৎ ২৪ জুলাই বৃহস্পতিবার পরিবারের সদস্যদের অলক্ষে বাড়ির দোতালায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী হয় নবম শ্রেণীর ছাত্র সূর্য মান্না আত্মহত্যার আগে একটি সুইসাইড নোট লিখে দিয়ে যায়।
এদিকে মৃত সূর্যের বন্ধুদের দাবি কয়েকজন মিলে ওই ছাত্রদের জোরপূর্বকভাবে বলিয়ে নেয় মেয়েকে তারা টিটকারি করেছে, এমন কি সেই কথোপকথন ভিডিও রেকর্ডিং করে তাঁরা। মেয়ের বাবা সহ দু’জনকে গ্রেফতারের পরও সেদিনকে কি ঘটনা ঘটেছিল জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে কাঁথি থানার পুলিশ।
ঘটনা জানতে পেরে গত ২৯ জুলাই মৃত ছাত্রের বাবা রবীন্দ্রনাথ মান্না কাঁথি থানায় মেয়ে বাবা, মেয়ে সহ ৫ জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, “আমার ছেলে এক বন্ধুর বাড়িতে ইংরেজি বই আনতে গিয়েছিল। অন্যজনের কাছ থেকে ফোনে জানতে পারি ছেলেকে পিছাবনী বাজারের সংলগ্ন এলাকায় আটকে রাখা হয়েছে। মেয়ের বাবা এখন জানাচ্ছে, এর আগে দু তিনবার নাকি কটুক্তি করেছে! তাহলে স্কুলে অভিযোগ নেই কেন? মেয়ের বাবা তার বন্ধু বান্ধব’কে নিয়ে এসে আমার ছেলে সহ তার বন্ধু’কে মারধর করেছে এবং ফাঁসিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয় ছেলেকে স্কুলের সামনে উলঙ্গ করে বসিয়ে রাখার হুমকিও দিয়েছে। তাদের শাস্তি চাই, যারা আমরা ছেলের উপর অত্যাচার করেছে। মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের কারণে আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে৷”
যদিও এমন অভিযোগ করেছেন মৃত সূর্যের বন্ধুরাও। সহপাঠী সৌভিক দাস বলেন, “বৃহস্পতিবার বিকেলে আমি এবং বন্ধুরা মিলে অপর এক বন্ধুর বাড়িতে বই আনতে গিয়েছিলাম৷ কে কি ওই মেয়েটাকে বলেছে আমরা জানি না? বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার সময় মেয়ের বাবা আর একজন মদ্যপ অবস্থায় লোক নিয়ে এসে আমাদেরআটকে রাখে। অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে এবং মারধর করে। শুধু তাই নয় জোর করে ভিডিও বানিয়েছে। এমনকি স্কুলের সামনে উলঙ্গ করে বসিয়ে রাখার হুমকিও দেয়। আমি চাই ওরা শাস্তি পাক। আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। হয়তো আগামী দিনে আমাদেরকে হেনস্থা করতে পারে৷”
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কাঁথিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। অনেকের মতে, এটি পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া চিপস-কাণ্ডেরই পুনরাবৃত্তি, যেখানে মিথ্যে অপবাদের জেরে আত্মঘাতী হয়েছিল সপ্তম শ্রেণির ছাত্র কৃষ্ণেন্দু দাস। সেখানেও একটি সুইসাইড নোটে সে লিখেছিল, সে চুরি করেনি।
এখন কাঁথির পিছাবনি এলাকার এই আত্মহত্যার ঘটনারও একই প্রশ্ন—মিথ্যা অপবাদে এক কিশোর প্রাণ হারাল! অভিযুক্তদের কড়া শাস্তির দাবিতে সরব এলাকাবাসী ও শিক্ষামহল। পুলিশের তদন্ত চলছে, এবং ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদও জারি রয়েছে।