মিলন পণ্ডা, কাঁথি: সহকারী প্রধান শিক্ষক (Assistant Headmaster) নিয়োগকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে উঠল পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি শহর। রবিবার দুপুরে কাঁথি পুরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা কিশোরনগর শচীন্দ্র শিক্ষা সদনের পরিচালন কমিটির সভাপতি নিত্যানন্দ মাইতি স্কুলের চত্বরে দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হন বলে অভিযোগ। তাঁকে স্কুল থেকে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় এবং হেনস্থা করা হয় বলে জানা গেছে। এই ঘটনায় তাঁর জামা ছিঁড়ে যায় এবং পরে তাঁকে কাঁথি মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে সোমবার সকালে স্কুল চত্বরে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা।
ঘটনার পরদিন অর্থাৎ সোমবার সকালে উত্তেজিত স্থানীয়রা স্কুল চত্বরে জড়ো হয়ে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। বিক্ষোভকারীরা স্কুলে তালা লাগিয়ে দেন, ফলে বহু ছাত্রছাত্রী নির্ধারিত সময়ে স্কুলে প্রবেশ করতে পারেনি। অভিভাবকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সহিংসতা মেনে নেওয়া যায় না। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি গণস্বাক্ষরিত স্বারকলিপি জমা দেন, যাতে অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি জানানো হয়।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাধামাধব দাস অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের নামে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। বর্তমানে পুলিশ গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং হামলাকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে খবর, রবিবার দুপুরে শচীন্দ্র শিক্ষা সদনে সরকারি প্রধান শিক্ষক নিয়োগের জন্য ইন্টারভিউ চলছিল। ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন কাঁথি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অনুপম সাহু, শচীন্দ্র শিক্ষা সদনের প্রধান শিক্ষক রাধামাধব দাস, এবং সভাপতিত্ব করছিলেন পরিচালন কমিটির সভাপতি নিত্যানন্দ মাইতি। জানা গেছে, এই প্রক্রিয়ার আগেই সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে দুই প্রার্থী শিবশঙ্কর কোটাল এবং সলিল ভৌমিককে ঘিরে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
বিশেষ সূত্রের দাবি, পরিচালন কমিটির সভাপতি সলিল ভৌমিককে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে বসাতে আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক রাধামাধব দাস সমর্থন করছিলেন শিবশঙ্কর কোটালকে। এই মতবিরোধ তৃণমূলের গোষ্ঠী রাজনীতির ইঙ্গিত দেয়। ইন্টারভিউ শুরু হতেই কয়েকজন বহিরাগত স্কুলে প্রবেশ করে নিত্যানন্দ মাইতিকে বাইরে ডেকে নিয়ে যায় এবং মারধর শুরু করে। অভিযোগ, এরপর তাঁকে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে হেনস্থা করা হয়।
এই ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার কয়েকশো স্থানীয় বাসিন্দা স্কুল চত্বরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁদের দাবি, প্রধান শিক্ষকের মদতেই এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় মহিলা কাকলি দাস বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা নেই প্রধান শিক্ষকের। তিনি অপকর্মে জড়িত। স্কুল থেকে তাঁকে সরিয়ে দিলেই পরিস্থিতি শান্ত হবে।”
অভিভাবকদের একাংশ বলেন, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হলে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা চরম ঝুঁকিতে পড়বে।
সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক রাধামাধব দাস বলেন, “রবিবার স্কুলে সরকারি প্রধান শিক্ষক নির্বাচনের জন্য ইন্টারভিউ চলছিল। সেই সময় কিছু অপরিচিত ব্যক্তি সভাপতিকে বাইরে নিয়ে যায় এবং হামলার ঘটনা ঘটে। আমরা পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ইন্টারভিউ বন্ধ করে দিই।”
প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যে দুষ্কৃতিকারীদের মদতের অভিযোগ উঠেছে, তা তিনি স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন। তাঁর কথায়, “অভিযোগগুলি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা থানায় অভিযোগ করেছি। রবিবার সিসি ক্যামেরা বৃষ্টির কারণে কাজ করছিল না। আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”
ঘটনার পর নিত্যানন্দ মাইতি বলেন, “আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে শিবশঙ্কর কোটালকেই সহকারী প্রধান শিক্ষক করতে হবে। দলের উচ্চ নেতৃত্বকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা যা সিদ্ধান্ত নেবে, আমি মেনে নেব।”
কাঁথি পুরসভার পুরপ্রধান সুপ্রকাশ গিরি বলেন, “আমি বিষয়টি জেনেছি, তবে আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া যায় না। কাউন্সিলর বা স্কুল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে চাইলে আমি সহযোগিতা করব।”
এই ঘটনার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। তাঁদের মতে, শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত ও সুরক্ষিত রাখতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক শিক্ষার পরিবেশ পায়।
ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে স্থানীয় সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে শিক্ষা মহলেও এই ঘটনায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার। কাঁথির এই ঘটনাটি দেখিয়ে দিল কিভাবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি শহরের এই ঘটনায় শুধু শিক্ষাঙ্গন নয়, গোটা জেলার মানুষ আতঙ্কিত। রাজনৈতিক দলের গোষ্ঠীকোন্দল যে শিক্ষাব্যবস্থাকে বিপদে ফেলছে, তা নতুন করে প্রমাণিত হলো। প্রশাসনের তৎপরতা এবং পুলিশের তদন্তের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সাধারণ মানুষ।
কাঁথির কিশোরনগর শচীন্দ্র শিক্ষা সদনে সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ ঘটল, তা শুধু একটি ঘটনার বর্ণনা নয়। এটি রাজনীতির অনুপ্রবেশে শিক্ষার পরিবেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার একটি উদাহরণ। এখন দেখার বিষয় প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই ঘটনায় কী পদক্ষেপ নেয়।