বাংলার রাজনীতিতে আবারও চিটফান্ড আতঙ্ক। এক সময় সারদা, রোজভ্যালির মতো কেলেঙ্কারিতে কেঁপে উঠেছিল রাজ্য। এবার একই পথে নতুন নাম—তহসিন আহমেদ। আসানসোলে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চিটফান্ড জালিয়াতির অভিযোগ ঘিরে ফের রাজনৈতিক মহলে তোলপাড়। এই ঘটনার সূত্র ধরে ফের তৃণমূল কংগ্রেসকে নিশানায় তুলেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
সূত্র অনুযায়ী, তহসিন আহমেদ পশ্চিম বর্ধমান জেলার সংখ্যালঘু তৃণমূল কংগ্রেসের সহ-সভাপতি মাস্টার শাকিল আহমেদের ছেলে। অভিযোগ, তিনি গত তিন বছর ধরে একটি ভুয়া এবং লাইসেন্সহীন চিটফান্ড কোম্পানি চালিয়ে আসানসোল ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছেন।
প্রলোভনের ফাঁদে সাধারণ মানুষ
অভিযোগ অনুযায়ী, এই কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছিল—যদি কেউ ১ লক্ষ টাকা ২০ মাসের জন্য জমা রাখে, তবে প্রতি মাসে ১৪ হাজার টাকা করে রিটার্ন পাবে। অর্থাৎ বিনিয়োগের শেষে তারা পেতেন ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা, সঙ্গে মূলধন ফেরত। শুনতে যতটা লোভনীয়, বাস্তবে ততটাই অসম্ভব। কিন্তু লোভের এই চক্রে পড়ে প্রায় ৩,০০০ জন বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কেউ মেয়ের বিয়ের সঞ্চয় দিয়েছেন, কেউ জমি বিক্রি করে টাকা তুলে দিয়েছেন, কেউ আবার ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন—আজ সবাই প্রতারিত।
তহসিন আহমেদ নাকি তিন বছর ধরে টাকা তোলার পর হঠাৎ ১৫ অক্টোবর থেকে বেপাত্তা। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই এখন থানা, আদালত এবং রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
রাজনৈতিক যোগসূত্রের অভিযোগ
শুভেন্দু অধিকারী তাঁর ফেসবুক পোস্টে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে লিখেছেন—
“মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল চাকরি চুরি থেকে শুরু করে যত রকম জালিয়াতি করা যায়, প্রায় সবেতেই সিদ্ধহস্ত। আসানসোলে এই চিটফান্ডের মাথা তহসিন আহমেদ—তৃণমূল নেতার ছেলে। শাসক দলের বড় বড় নেতা এবং প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন মদত ছাড়া এটা সম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন, “এই টাকা কেবল প্রতারণায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বেনামি সম্পত্তি কেনা, রাজনৈতিক তহবিল গঠন এবং সম্ভবত দেশবিরোধী কার্যকলাপে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা, তা তদন্তের দাবি রাখে।”
শুভেন্দুর অভিযোগ, তহসিন আহমেদ এবং তার সহযোগীরা একযোগে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা চালিয়ে গিয়েছেন, আর প্রশাসন নীরব থেকেছে। তিনি SEBI ও ED-এর হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়ে বলেন, প্রতারিতদের যেন দ্রুত ন্যায়বিচার ও অর্থ ফেরতের ব্যবস্থা করা হয়।
সুদীপ্ত সেন থেকে তহসিন: ইতিহাস কি পুনরাবৃত্তি করছে?
বাংলায় চিটফান্ড কেলেঙ্কারির ইতিহাস নতুন নয়। সুদীপ্ত সেনের সারদা গ্রুপ এবং রোজভ্যালি স্ক্যান্ডাল-এর পর থেকে রাজ্যবাসী চরম সতর্ক হলেও, প্রতারণার নতুন রূপ বারবার ফিরে আসছে। এবার সেই প্রতারণা যেন নতুন রূপে রাজনৈতিক ছায়ায় আবৃত।
অর্থনীতিবিদদের মতে, “এই ধরনের বিনিয়োগ স্কিমে অবাস্তব রিটার্নের প্রতিশ্রুতি থাকলে সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে। ২০ মাসে ১৮০% লাভ দেওয়া অর্থনৈতিকভাবে অসম্ভব।”
প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
এখনও পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে পুলিশের সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগকারীরা থানায় একাধিক এফআইআর দায়ের করেছেন। তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানা গেলেও, মূল অভিযুক্ত এখনো অধরা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই কেলেঙ্কারি যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তবে তা শুধু আসানসোল নয়—পুরো পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেই ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, এর সঙ্গে যদি শাসকদলের নেতাদের যোগসূত্র মেলে, তবে তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা দেবে।
চিটফান্ড নামেই মানুষ আজ আতঙ্কিত। তহসিন আহমেদের ঘটনায় আবারও সেই পুরনো দুঃস্বপ্ন ফিরে এসেছে। সাধারণ মানুষের সঞ্চয় যেন বারবার রাজনৈতিক ছায়ায় হুমকির মুখে পড়ছে। শুভেন্দু অধিকারীর দাবি অনুযায়ী, যদি এই অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়, তবে বাংলায় চিটফান্ডের অন্ধকার অধ্যায়ে যুক্ত হবে আরেকটি নাম—তহসিন আহমেদ।