পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেই ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবার রাজ্যে নিজের সাংগঠনিক উপস্থিতি আরও জোরদার করছে। ভোট সবে চার মাস দূরে, আর সেই প্রেক্ষাপটেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির অন্যতম কৌশলগত নেতৃত্ব অমিত শাহ (Amit Shah) আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করলেন ‘মিশন বেঙ্গল’।
দলের শীর্ষ সূত্রের মতে, নির্বাচনের আগে আগামী ছয় মাসের জন্য বিজেপি মোট ৬ জন সংগঠন সম্পাদক ও ৬ জন সিনিয়র নেতাকে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে মোতায়েন করেছে। তাদের দায়িত্ব—মাঠপর্যায়ের সংগঠন শক্তিশালী করা, গোষ্ঠী–সমীকরণ সামলানো, বুথ শক্তি পুনর্গঠন এবং ভোটারের মনোভাব বিশদভাবে বোঝা।
এই ১২ সদস্যের দলকে রাজ্যের ছয়টি কৌশলগত অঞ্চলে ভাগ করে পাঠানো হয়েছে—
-
উত্তরবঙ্গ: অনন্ত নারায়ণ মিশ্র
-
রাঢ় অঞ্চল: পবন সাই ও ধন সিং রাওয়াত
-
হাওড়া অঞ্চল: পবন রানা ও সঞ্জয় ভাটিয়া
-
মেদিনীপুর: জে.পি.এস রাঠোর
-
দক্ষিণ ২৪ পরগনা: এম. সিদ্ধার্থন ও সি.টি. রবি
-
সিলিগুড়ি অঞ্চল: অরুণ বিন্নাদি
দলীয় সূত্র বলছে, প্রত্যেক নেতা তাঁদের নির্দিষ্ট অঞ্চলে থেকেই প্রতিদিন সংগঠন সংক্রান্ত কাজের তদারকি করবেন এবং সরাসরি দিল্লির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে রিপোর্ট করবেন।
🔶 অমিত শাহের ঘন ঘন রাজ্য সফর: ‘ফুল ওয়ার মোড’-এ বিজেপি
বিজেপির রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতে, এবার অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে প্রতি মাসে একাধিকবার সফর করবেন। তাঁর সফরের মূল লক্ষ্য—
-
অঞ্চলভিত্তিক সাংগঠনিক মূল্যায়ন
-
প্রার্থী বাছাইয়ের পূর্ব বিশ্লেষণ
-
দুর্বল বুথমণ্ডলীর পুনর্গঠন
-
স্থানীয় অসন্তোষ বা ভাঙনের জায়গা চিহ্নিত করা
-
দলীয় প্রচারযন্ত্রকে চালু রাখার প্রস্তুতি
রাজনৈতিক মহলের মতে, বিজেপি এবার স্পষ্টতই “গ্রাউন্ড-হেভি” কৌশল নিয়েছে—অর্থাৎ, স্থানীয় স্তরের দলীয় শক্তিকে পুনর্গঠনের দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।
🔶 কেন এত বড় সাংগঠনিক মোতায়েন?
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৭৭টি আসন পেয়েছিল—রাজ্যে তাদের সর্বোচ্চ। তবে ২০২৫ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্য স্পষ্ট করেই দল এবার আরও শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে চাইছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপি বিশেষ করে নিম্নলিখিত বিষয়ে জোর দিচ্ছে—
-
দুর্বল বুথগুলো পুনর্গঠিত করা
-
উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহলে সংগঠন পোক্ত করা
-
মেদিনীপুর ও হাওড়ায় সাংগঠনিক ক্ষয়পূরণ
-
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা
এর পাশাপাশি, বিজেপি এবার দলীয় বিদ্বেষ ও গোষ্ঠীকোন্দল কমানোর দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাইছে।
🔶 মাঠপর্যায়ের বার্তা: ঘরোয়া বিরোধ মেটানোই বড় চ্যালেঞ্জ
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, স্থানীয় স্তরে বিজেপির মধ্যে গোষ্ঠী সংঘাত, পুরনো-নতুন নেতা–কর্মীর দ্বন্দ্ব এবং সাংগঠনিক অসামঞ্জস্য ভোটের সময় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই কারণেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবার পুরো বিষয়টিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে। নতুন মোতায়েন হওয়া নেতাদের অন্যতম কাজ হলো—
-
স্থানীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলানো
-
কর্মীদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা
-
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও বুথ টিমের মধ্যে ফাঁক কমানো
-
দলীয় প্রচারকে সমন্বিত করা
🔶 তৃণমূলের ঘাঁটিতে ঢোকার কৌশল: বিজেপি এবার ‘মাইক্রো বেন্চমার্কিং’ করবে
বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে—এবার তারা প্রতিটি ব্লক, প্রতিটি মণ্ডল এবং প্রতিটি বুথ–স্তরে টার্গেট ঠিক করে কাজ করবে। এই প্রক্রিয়াকে তারা বলছে—
“Micro Benchmarking Strategy।”
এর লক্ষ্য—
-
কোন এলাকায় কী সমস্যা
-
কোন বয়সগোষ্ঠী কোন ইস্যুতে প্রভাবিত
-
কাদের মধ্যে অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি প্রবল
-
কোন সম্প্রদায়ের ভোট কোন দিকে ঝুঁকছে
এই তথ্য অনুযায়ী প্রচার পরিকল্পনা সাজানো হবে।
🔶 তৃণমূল-বিজেপি দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হওয়ার ইঙ্গিত
মিশন বেঙ্গল শুরু হওয়ায় রাজনৈতিক মহল মনে করছে—
আগামী কয়েক মাসে রাজ্যের রাজনৈতিক উত্তাপ অনেকটাই বাড়বে।
তৃণমূল কংগ্রেস ইতিমধ্যেই বলেছে—
কেন্দ্র “রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ” বাড়াতে চাইছে।
অন্যদিকে বিজেপি বলছে—
“এ রাজ্যে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্যই আমাদের বাড়তি প্রচেষ্টা।”
🔶 সামগ্রিক মূল্যায়ন
বিধানসভা নির্বাচন মাত্র চার মাস দূরে। এই সময়েই বিজেপির ১২ জন শীর্ষ পর্যায়ের সংগঠককে ছয় মাসের জন্য স্থায়ী মোতায়েন—
রাজ্যে দলটির আগ্রাসী মোডের স্পষ্ট ইঙ্গিত।
অমিত শাহের ঘন ঘন সফর, বুথভিত্তিক পরিকল্পনা, গোষ্ঠী-সমস্যা নিরসন ও টার্গেটেড প্রচার—সব মিলিয়ে বিজেপি এবার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টায় “ফুল ওয়ার মোড”-এ।
আগামী কয়েক মাসে এই তীব্র রাজনৈতিক লড়াই রাজ্যের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে।
