নিজস্ব সংবাদদাতা, পশ্চিম মেদিনীপুর: বারবার আক্রমণ করেও থামাতে পারেনি জেলিফিশের দল! সমস্ত বাধা ও শারীরিক কষ্ট পেরিয়ে গত ২৯ জুলাই রাত ৯টা ৩১ মিনিটে সৃষ্টি হয়েছিল এক নতুন ইতিহাস। মাত্র ১৩ ঘণ্টা ১৩ মিনিটে ‘ইংলিশ চ্যানেল’ অতিক্রম করে ইতিহাস গড়েছেন পশ্চিম মেদিনীর গর্ব, ‘মেদিনীকন্যা’ আফরিন জাবি (Afreen Zabi)। অবিভক্ত মেদিনীপুরের ইতিহাসে এই কৃতিত্ব এই প্রথম।
বীরযোদ্ধার মতো আফরিনের মেদিনীপুরে প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় গোটা শহর। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পবিত্র মাটিতে পা রাখতেই তাঁকে বরণ করা হয় রাজকীয় সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে। কয়েকদিন আগেই দাদা ও বৌদির সঙ্গে লন্ডন থেকে দিল্লি ফিরেছিলেন আফরিন। দিল্লিতে দাদার বাড়িতেই কাটছিল এই ক’দিন। অবশেষে এদিন ট্রেনে করে পশ্চিম মেদিনীপুরে ফিরলেন তিনি।
খড়গপুরের হিজলি স্টেশন-এ নামার পরই শুরু হয় উচ্ছ্বাসের বন্যা। বাবা সেখ পিয়ার আলি, মা সাবিনা পারভিন, দাদা আদিল মহম্মদ ও বৌদি রিজওয়ানা ইয়াসমিন ছিলেন তাঁর সঙ্গী। স্টেশনেই ফুল ও উত্তরীয় দিয়ে তাঁকে বরণ করে নেয় মেদিনীপুর সুইমিং ক্লাব। এরপর সেখান থেকে সুসজ্জিত বাইক র্যালির মাধ্যমে তাঁকে শহরে আনা হয়। আফরিন ছিলেন হুডখোলা জিপে, চারপাশে উল্লাসিত জনতার ভিড়।
মেদিনীপুর সুইমিং ক্লাবে আয়োজন করা হয় রাজকীয় সংবর্ধনার। এরপর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করেন আফরিন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মেদিনীপুরের বিধায়ক সুজয় হাজরা, পুরপ্রধান সৌমেন খান, মেদিনীপুর সুইমিং ক্লাবের সম্পাদক পল্লব কিশোর চ্যাটার্জি, জেলা সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তনু ঘোষ প্রমুখ।
সংবর্ধনা সভায় আবেগভরা কণ্ঠে আফরিন বলেন, “আমি ছোট থেকে শান্তনু ও বাবুন স্যার-এর কাছে প্র্যাকটিস করেছি। কিন্তু, ইংলিশ চ্যানেলের জন্য গত দু-এক বছর ধরে কলকাতার বিশ্বজিত স্যার-এর কাছে, লেক টাউনের লেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বাবা-মা’র অবদান ছাড়া এতদূর আসা সম্ভব হত না।”
৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ, হিমশীতল জলের এই পথ পাড়ি দেওয়া সহজ নয়। আফরিন বলেন, “অনেকেই ওই আবহাওয়া আর জেলিফিশের কারণে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করতে পারেন না। আমার পাইলট ওইদিন বলেছিলেন, আবহাওয়া ভালো আছে। ভেবেছিলাম ৮ ঘণ্টায় শেষ করব, কিন্তু শেষ এক কিলোমিটার পেরোতে লেগেছে চার-পাঁচ ঘণ্টা। চারবার জেলিফিশ আক্রমণ করেছে আমাকে।”
এমন চরম চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দমে যাননি আফরিন। বরং শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে তিনি সম্পূর্ণ করেন এই ঐতিহাসিক সাঁতার। এই সাফল্যের পর থেমে নেই আফরিনের স্বপ্ন। তাঁর পরবর্তী লক্ষ্য জিব্রাল্টার প্রণালী পেরোনো। ইতিমধ্যেই তিনি সেই প্রস্তুতির জন্য মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছেন।
মেদিনীপুরের মানুষের কাছে আফরিন শুধু এক সাঁতারু নন, তিনি এখন অনুপ্রেরণার প্রতীক। ছোট শহরের এক মেয়েও যে দৃঢ়সংকল্প, কঠোর পরিশ্রম ও পরিবারের সমর্থনে বিশ্ব জয় করতে পারে—তার জীবন্ত প্রমাণ আফরিন জাবি।
মেদিনীপুরবাসী বিশ্বাস করে, আজকের এই কৃতিত্ব একদিন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া জগতে ভারতের জন্য আরও বহু সম্মান বয়ে আনবে। আফরিনের হাত ধরে মেদিনীপুরের নাম পৌঁছাবে বিশ্বমানচিত্রের আরও বহু গৌরবময় আসনে।