জনস্বার্থ মামলা (Public Interest Litigation বা PIL) মূলত সমাজের গরিব, বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক অস্ত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই ব্যবস্থার চেহারাই যেন বদলে যাচ্ছে। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হয়ে উঠছে এই ‘জনস্বার্থ’ নামক ধারণা। আর সেই অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এবার মুখ খুলল কলকাতা হাইকোর্ট।
বুধবার কলকাতা হাইকোর্টের (Calutta High Court) বিচারপতি সুজয় পাল ও বিচারপতি কৌশিক চন্দের ডিভিশন বেঞ্চ একটি মামলার শুনানিতে পর্যবেক্ষণ দেয় যে, জনস্বার্থ মামলা দায়েরের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে যেন নষ্ট করা না হয়। তাঁরা বলেন, “জনস্বার্থ মামলার অপব্যবহার বন্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই মামলার ধারণাটি গঠিত হয়েছিল গরিব, প্রান্তিক এবং বঞ্চিত মানুষের কথা আদালতের সামনে তুলে ধরার জন্য। কিন্তু আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং বিচারব্যবস্থার অপমান।”
এদিন যে মামলাটি খারিজ করেছে ডিভিশন বেঞ্চ, সেটি এক মতুয়া সংগঠনের তরফে দায়ের করা হয়েছিল। মামলাটিকে জনস্বার্থ মামলা হিসেবে পেশ করা হলেও, আদালতের মতে এর মধ্যে জনস্বার্থের কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না। বরং সেটি ছিল একটি ‘নিজস্ব গোষ্ঠীগত স্বার্থে দায়ের করা আবেদন’, যাকে আদালত গুরুত্ব না দিয়ে সরাসরি খারিজ করে দেয়।
জনস্বার্থ মামলার উদ্দেশ্য কী?
জনস্বার্থ মামলা ভারতের সংবিধান অনুযায়ী এমন এক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি বা সংস্থা এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে। কোনো গরিব, নির্যাতিত ব্যক্তি আদালতের কাছে যেতে না পারলে, একজন সচেতন নাগরিক তাঁর হয়ে মামলার আবেদন করতে পারেন।
এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বহু ঐতিহাসিক রায় এসেছে—পরিবেশ সংরক্ষণ, শ্রমিক অধিকার, মানবাধিকার রক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে। কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, জনস্বার্থের আড়ালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ব্যক্তি স্বার্থ বা মিডিয়া প্রচারের অভিপ্রায় লুকিয়ে থাকে।
আদালতের বার্তা: সতর্ক হোন
এই প্রেক্ষিতেই বিচারপতি সুজয় পাল স্পষ্ট ভাষায় জানান, “জনস্বার্থ মামলার নামে আদালতের সময় ও সংস্থান নষ্ট করা চলবে না। যদি কোনো মামলা থেকে বোঝা যায় সেটির উদ্দেশ্য জনস্বার্থ নয়, তাহলে তা খারিজ করা হবে, এমনকি দায়েরকারীকে জরিমানাও করা হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “বিচারব্যবস্থার এই অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং দরকারি ব্যবস্থাকে কেউ যেন খেলাচ্ছলে বা স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার না করে।”
রাজনৈতিক অভিসন্ধি বা সত্যিকারের জনস্বার্থ?
মতুয়া সংগঠনের পক্ষ থেকে যদিও দাবি করা হয়েছিল যে এই মামলা জনস্বার্থে, কিন্তু আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে এতে জনস্বার্থের বাস্তবিক কোনো ভিত্তি নেই। বরং, মামলার বিষয়বস্তু এবং প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে আদালত মনে করেছে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই ধরনের মামলার পুনরাবৃত্তি হলে ভবিষ্যতে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন বিচারপতিরা।