ইম্ফল: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শনিবার মণিপুর সফরে এসে রাজ্যের জন্য প্রায় ১,২০০ কোটি টাকার ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করলেন। দীর্ঘ দিন পর মোদির এ সফরকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ ২০২৩ সালের মে মাসে মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর এই প্রথম তিনি ইম্ফলে পা রাখলেন। অনুষ্ঠানের মূল আয়োজন হয় ঐতিহাসিক কাংলা ফোর্ট কমপ্লেক্সে, যেখানে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
মণিপুর পুলিশ সদর দফতর এবং সিভিল সচিবালয় ভবন
প্রধানমন্ত্রী যে প্রকল্পগুলির উদ্বোধন করেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নতুন মণিপুর পুলিশ সদর দফতর এবং সিভিল সচিবালয় ভবন। রাজধানী ইম্ফলের মন্ত্রিপুখরি এলাকায় অবস্থিত এই দুই অবকাঠামো প্রকল্পে যথাক্রমে ১০১ কোটি এবং ৫৩৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর ফলে মণিপুর প্রশাসনের কাজকর্ম আরও গতি পাবে বলে মনে করছেন রাজ্যবাসী।
রাজধানীর সৌন্দর্যায়ন এবং নগর উন্নয়নের দিকেও বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ইম্ফল নদীর পশ্চিম অংশের উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ এবং মল রোডের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এই দুটি প্রকল্প পূর্ণ হলে রাজধানীর নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি পাবে এবং পর্যটন শিল্পেরও উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মহিলাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চারটি নতুন ‘ইমা বাজার’ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মণিপুরের মহিলাদের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ভাষায় ‘ইমা’ মানে ‘মা’। এই বাজারগুলিতে মহিলারাই ব্যবসা পরিচালনা করেন এবং বহু বছর ধরে এগুলি মণিপুরের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রতীক হয়ে আছে।
আর কী কী উদ্বোধন Manipur Infrastructure Development
এছাড়াও, ইম্ফল পশ্চিম জেলায় ‘লেইশাং হাইডেন কালচারাল অ্যান্ড হেরিটেজ পার্ক’-এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই পার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একই সঙ্গে ইম্ফল পশ্চিম, থৌবাল এবং কাকচিং জেলায় পাঁচটি সরকারি কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পেরও উদ্বোধন করা হয়। এর মাধ্যমে রাজ্যের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নোনেই জেলার ইরাং নদীর উপর নির্মিত চার লেনের সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এই সেতুটি ইম্ফল-জিরিবাম জাতীয় সড়ক (এনএইচ-৩৭)-কে আরও কার্যকরভাবে সংযুক্ত করবে। দীর্ঘদিন ধরেই এই সড়ককে মণিপুরের লাইফলাইন হিসেবে ধরা হয়। ফলে নতুন সেতুটি শুধু অর্থনৈতিক আদান-প্রদানই নয়, মানুষে মানুষে সংযোগ বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে।
স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন
স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য চাকচাঁদপুর জেলার সাইকট কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে একটি নতুন ইনস্টিটিউশনাল বিল্ডিং এবং কর্মী কোয়ার্টার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে সীমান্তবর্তী এই জেলায় স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত হবে এবং স্থানীয় জনগণ আরও সহজে চিকিৎসা সুবিধা পাবেন।
রাজধানী দিল্লি এবং কলকাতায় ‘মণিপুর ভবন’-এরও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের অন্য বড় শহরে পড়াশোনা, চিকিৎসা বা কর্মসূত্রে যাওয়া মণিপুরের মানুষ এই ভবনগুলির মাধ্যমে স্বস্তি ও সহায়তা পাবেন। একই সঙ্গে এগুলি মণিপুরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করবে।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে কেন্দ্র করে ইম্ফলে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে অশান্ত পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যাওয়া রাজ্যের জন্য এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলি নতুন আশার সঞ্চার করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, “মণিপুর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উন্নয়ন, শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
মোদীর এই সফরের মাধ্যমে কেন্দ্র সরকার একদিকে যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে সামাজিক সম্প্রীতি পুনঃস্থাপনের বার্তাও দিতে চাইছে। ২০২৩ সালের সহিংসতা রাজ্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। এই নতুন প্রকল্পগুলি সেই ক্ষত সারাতে সাহায্য করবে কিনা, তা সময়ই বলবে। তবে আপাতত মণিপুরবাসীর চোখে এ যেন নতুন ভোরের প্রতীক।