‘বিরোধী’। শব্দটি বাংলার রাজনীতির সঙ্গে যেন সামঞ্জস্যতা রেখেছে বরাবর৷ ১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসুর সরকার ক্ষমতায় বসেছে। তারপর একাধিকবার কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জোট নিয়ে একাধিক সমীকরণ চলেছে। কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু বিরোধী শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেখেছে পশ্চিমবঙ্গ৷ ঠিক তেমনই এরাজ্যে ক্ষুরধার বিরোধী পক্ষের তকমা পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু মমতা ক্ষমতায় আসতেই বিরোধী তেজের আগুন যেন ম্লান হতে শুরু করেছে। অন্তত সাম্প্রতিককালে সেটাই বারবার দেখা গেছে।
অতি সম্প্রতিতে রাজ্য সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির পর্দাফাঁস হয়েছে বারংবার৷ আদালতের নির্দেশে বহু কর্মরত শিক্ষক চাকরি হারিয়েছে। এমনকি দুর্নীতির কারণে মন্ত্রীর মেয়েকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে আদালত। পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়নি রাজ্য৷ অর্থাৎ দুর্নীতি হয়েছে। রাজ্যের নীরব দর্শকের ভূমিকা তার বার্তা দিচ্ছে। যেটার অভাব রয়েছে সেটা হল এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ঝাঁঝ।
আজ নিয়ে তিন দফায় ৫০৪ দিনে পড়ল ধর্মতলায় গান্ধী মূর্তির পাদদেশে হবু শিক্ষকদের আন্দোলন৷ বহুবার তাঁদের আন্দোলন মঞ্চে বিজেপি, কংগ্রেস এবং বাম নেতাদের উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। বারবার চাকরির দাবিতে রাজপথে মিছিল নেমেছে। গোটা বিষয়টাকে দেখে মনে হয়েছে দপ করে জ্বলে উঠে আবার আগুন নিভে গেল। এই আন্দোলনের মধ্যে ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
বিরোধী পক্ষের সমস্ত দলের তরফে জেলায় জেলায় মিছিল করা হচ্ছে৷ মানুষের মধ্যে সরকারের দুর্নীতির ঢোল পেটানো হচ্ছে৷ বারবার টিভিতেও সেটা দেখানো হচ্ছে। আবার কোথাও মনে হচ্ছে বিরোধীরা ছন্নছাড়া। শাসক দলের বিপক্ষে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা আম জনতার মধ্যে তাঁদের গুরুত্ব বোঝাতে পারছে না তাঁরা৷
রাজনৈতিক মহলের একাংশের বক্তব্য, বাম জমানায় একেবারে রনংদেহী মনোভাব ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ সরকারের যে কোনও কারনামার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি। যার উদাহরণস্বরূপ সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের আন্দোলন। যা ক্ষমতায় অলিন্দ থেকে বামেদের সরিয়ে দিয়েছিল৷ পরবর্তীতে সেই আন্দোলনের ঝাঁঝা ধরে রাখতে পারেননি সূর্যকান্ত মিশ্ররা৷
২০২১ সালের বিধানসভার আগে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে কিছুটা এগিয়েছিল বিজেপি৷ রাজনীতিতে তারও আগ্রাসী মনোভাব দেখেছে বাংলার মানুষ৷ কিন্তু দলের নির্দেশ মানতে গিয়ে দিলীপ ঘোষ এখন অনেকটাই ব্যাকফুটে৷ সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য মার্জনীয় হলেও সেভাবে ঝাঁঝ নেই। তবে কি আরএসএসের নির্দেশে ধীরে চলো নীতি নিয়ে চলছেন বঙ্গ বিজেপির নেতারা? এই প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক মহলে।
তবে দলীয় সংগঠনকে পুনরায় উদ্ধার করতে নেমে আক্রমণের সুর বদলে ফেলেছেন সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম৷ আক্রমণের পুরোভাগে রয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, সুজন চক্রবর্তীদের মতো নেতারা। সেই তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে কংগ্রেস। তার প্রধান কারণ রাজ্যে তাদের দলীয় সংগঠন হতে পারে। একা অধীর রঞ্জন চৌধুরী ছাড়া কাউকে ফোকাসে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর টাকা সমেত তিন ঝাড়খণ্ডের বিধায়কদের আটকের ঘটনায় এখন তাঁদের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে৷
এদিকে নিয়মিত দুর্নীতিতে জর্জরিত শাসক দল৷ প্রতিদিন নিয়ম করে ইডি অথবা সিবিআই দফতরে হাজিরা দিতে হচ্ছে তৃণমূল নেতাদের৷ শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি ছাড়াও কয়লা পাচার, গরু পাচার সহ একাধিক দুর্নীতিতে নাম জড়িয়েছে বহু নেতা, বিধায়ক, সাংসদ, এমনকি মন্ত্রীদের। এই ইস্যুকে সামনে রেখে আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়ানো ভীষণ জরুরী বলে করছে রাজনৈতিক মহল৷ না হলে ভোটের আগে কৌশলে শেষ চালে বাজিমাত করতে পারে শাসক দল তৃণমূল৷