আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণায় ভারতের রপ্তানি পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ফি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারত সরকার গভীর পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে। বৃহস্পতিবার লোকসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল (Piyush Goyal) জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এই সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করছে এবং দেশের স্বার্থ রক্ষায় সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
লোকসভায় পীযূষ গোয়েলের বক্তব্য:
লোকসভায় এক বিবৃতি প্রদানকালে মন্ত্রী বলেন, “২ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন, যেখানে ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা প্রতিযোগিতামূলক শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়। এই আদেশ অনুযায়ী ৫ এপ্রিল থেকে ১০% বেসলাইন ডিউটি কার্যকর হয়েছে, যা ধাপে ধাপে ২৬% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ৯ এপ্রিল থেকে নির্দিষ্টভাবে ভারতের জন্য প্রযোজ্য অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও, তা প্রথমে ৯০ দিনের জন্য এবং পরবর্তীতে ১ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “ভারত এই ধরনের সিদ্ধান্তের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করছে এবং বাণিজ্য আলোচনার সময় ভারতের কৃষক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং জাতীয় স্বার্থকে সর্বাগ্রাধিকার দেওয়া হবে।”
ট্রাম্পের ঘোষণা: রাশিয়া ঘনিষ্ঠতা ও বাণিজ্য নীতির উপর ক্ষোভ:
বুধবার একটি Truth Social পোস্টে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “ভারতের শুল্ক হার অত্যধিক এবং অ-আর্থিক বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা অত্যন্ত কঠোর। তাই ভারতের সমস্ত পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক কার্যকর হবে ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে, পাশাপাশি রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল ও সামরিক সরঞ্জাম কেনার কারণে অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ফি আরোপ করা হবে।”
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “ভারত আমাদের বন্ধু, তবে তাদের সঙ্গে ব্যবসা কম হয়েছে কারণ তাদের শুল্ক অত্যন্ত বেশি। তাছাড়া, তারা বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতার দেশগুলির একটি।” রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প ভারত ও চীনের রাশিয়ার জ্বালানির বড় ক্রেতা হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “ভারত ও রাশিয়া যদি একসঙ্গে তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি নিচে নামায়, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”
ভারতের পাল্টা প্রতিক্রিয়া: স্বার্থ রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ কেন্দ্র:
এই প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “আমরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণার কথা অবগত হয়েছি এবং এই বিষয়ে বিশদ পর্যালোচনা চলছে। ভারত ও আমেরিকার মধ্যে একটি সুষম, ন্যায্য এবং পারস্পরিক উপযোগী বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। আমরা সেই লক্ষ্যেই অঙ্গীকারবদ্ধ।”
সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, “ভারত সরকার সব সময় দেশের কৃষক, উদ্যোক্তা, MSME তথা সাধারণ জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও সেই নীতি বজায় রাখা হবে। যেমন সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সই হওয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতেও হয়েছে।”
ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা তুলে ধরেন গোয়েল:
লোকসভায় পীযূষ গোয়েল ভারতের অর্থনৈতিক সাফল্য তুলে ধরে বলেন, “গত এক দশকে ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে একাদশ স্থান থেকে উঠে এসে পঞ্চম স্থানে পৌঁছেছে। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে দেশের কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং MSME-দের অক্লান্ত পরিশ্রম।”
তিনি বলেন, “আমরা আত্মনির্ভর ভারতের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি এবং এই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে সক্ষম।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত: চাপে পড়তে পারে ভারতীয় রপ্তানি খাত:
বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত ভারতের পাট, গার্মেন্টস, চামড়া, ইলেকট্রনিক্স ও ফার্মাসিউটিক্যালস রপ্তানির উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যখন ভারতের সঙ্গে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ট্রাম্পের এই ঘোষণায় ভারত-আমেরিকা বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন সংকটে পড়েছে। তবে ভারত সরকার আশ্বস্ত করেছে, দেশীয় শিল্প ও কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আগামী দিনে দুই দেশের আলোচনায় কী সিদ্ধান্ত আসে, তার দিকেই এখন তাকিয়ে রয়েছে গোটা দেশ।