নিজস্ব সংবাদদাতা, নয়াদিল্লি, ২৮ জুলাই ২০২৫: কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য ৮ম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। প্রায় ৫০ লক্ষ কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগী এই কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষায় রয়েছেন, যা তাদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। তবে, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—২০২৬ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কি এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হবে? জুলাই ২০২৫-এর সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী, এই বিষয়ে সরকারের অগ্রগতি ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে।
৮ম বেতন কমিশন: বর্তমান অবস্থা
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ৮ম বেতন কমিশন গঠনের অনুমোদন দিয়েছে। এই কমিশনের লক্ষ্য হলো কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামো, ভাতা এবং পেনশন সংশোধন করা, যা মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। তবে, জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত কমিশনের চেয়ারপার্সন এবং সদস্যদের নিয়োগ বা কার্যপরিধি (Terms of Reference – ToR) চূড়ান্ত করা হয়নি। এই বিলম্ব নিয়ে কর্মচারী ইউনিয়নগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
লোকসভায় অর্থ প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরী জানিয়েছেন, “প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কর্মী ও প্রশিক্ষণ বিভাগ (DoPT) এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হলে চেয়ারপার্সন ও সদস্যদের নিয়োগ করা হবে। সুপারিশ গ্রহণের পরই বাস্তবায়নের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।”
লোকসভা নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন সম্ভব?
২০২৬ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময়সীমার কথা বিবেচনা করলে, ৮ম বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, বেতন কমিশনের সুপারিশ তৈরি ও বাস্তবায়নের জন্য ১৮-২৪ মাস সময় লাগে। ৭ম বেতন কমিশন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল এবং ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে কার্যকর হয়েছিল। একইভাবে, ৮ম বেতন কমিশনের ক্ষেত্রেও ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সুপারিশ জমা দেওয়া এবং ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল। তবে, বর্তমান গতি বিশ্লেষণ করলে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন যে বাস্তবায়ন ২০২৬-এর শেষ বা ২০২৭-এর শুরু পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে।
২০২৬ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বেতন বৃদ্ধি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব টিভি সোমনাথন স্পষ্ট করেছিলেন যে নির্বাচনের আগে ৮ম বেতন কমিশন গঠনের কোনো পরিকল্পনা নেই। যদিও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কমিশন ঘোষণা করা হয়েছে, তবুও এর পূর্ণ গঠন ও সুপারিশ তৈরির জন্য সময় প্রয়োজন। এই বিলম্বের কারণে কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, যারা আশা করছিলেন নির্বাচনের আগে বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা পেতে।
ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ও বেতন বৃদ্ধির সম্ভাবনা
৮ম বেতন কমিশনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, যা বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ নির্ধারণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ফ্যাক্টর ১.৯২ থেকে ২.৮৬ এর মধ্যে হতে পারে। ৭ম বেতন কমিশনে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭, যার ফলে ন্যূনতম মূল বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮,০০০ টাকা হয়েছিল। এবার যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৯২ হয়, তবে একজন লেভেল-১ কর্মচারীর মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৩৪,৫৬০ টাকা হতে পারে। আর যদি ফ্যাক্টর ২.৮৬ হয়, তবে বেতন বেড়ে ৫১,৪৮০ টাকা হতে পারে। তবে, মহার্ঘ ভাতা (Dearness Allowance – DA) শূন্যে রিসেট হওয়ায় প্রকৃত বৃদ্ধি কিছুটা কম হতে পারে।
কিছু রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে বেতন বৃদ্ধি ৩০-৩৪% এর মধ্যে হতে পারে, যা প্রায় ১ কোটি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতে, এই বৃদ্ধি মাসিক বেতনে ১৯,০০০ টাকা পর্যন্ত বাড়াতে পারে। কোটাক ইনস্টিটিউশনাল ইকুইটিসের মতে, এই বেতন বৃদ্ধি অর্থনীতিতে ০.৬-০.৮% জিডিপি’র সমান অতিরিক্ত ব্যয় সৃষ্টি করবে, যা অটোমোবাইল ও ভোগ্যপণ্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সমর্থকদের প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ
কর্মচারী ইউনিয়নগুলো বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন ত্রাণ (interim relief) দাবি করছে। বর্তমানে মহার্ঘ ভাতা ৫৫% এ রয়েছে, এবং জুলাই ২০২৫-এ আরেকটি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, নতুন বেতন কমিশন কার্যকর হলে মহার্ঘ ভাতা শূন্যে রিসেট হবে, যা বেতনের মোট বৃদ্ধির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও বড় বাধা। সরকারকে কল্যাণমূলক ব্যয়, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং রাজস্ব ঘাটতির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই কারণে বেতন বৃদ্ধির বাস্তবায়ন নির্বাচনের পরে পিছিয়ে যেতে পারে। এক্স-এর পোস্টগুলোতে এই বিষয়ে হতাশা প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে কেউ কেউ মনে করছেন যে ২০২৮ সালের আগে বাস্তবায়ন সম্ভব নাও হতে পারে।
সমাজে ও অর্থনীতিতে প্রভাব
৮ম বেতন কমিশনের বাস্তবায়ন শুধু কর্মচারীদের জন্যই নয়, গোটা অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বেতন বৃদ্ধি ভোগ্যপণ্য, অটোমোবাইল এবং রিয়েল এস্টেট খাতে চাহিদা বাড়াতে পারে। ৭ম বেতন কমিশন ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি বৃদ্ধিতে প্রায় ২% অবদান রেখেছিল। তবে, বিলম্ব হলে কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে পারে, যা রাজনৈতিকভাবেও প্রভাব ফেলতে পারে।
৮ম বেতন কমিশন নিয়ে জুলাই ২০২৫-এর আপডেট স্পষ্ট করে যে সরকার প্রস্তুতি শুরু করলেও, লোকসভা নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম। ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর এবং পে ম্যাট্রিক্স নিয়ে আলোচনা চলছে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও অধরা। কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা আশা করছেন যে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, যাতে তাঁদের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। এখন দেখার বিষয়, সরকার কীভাবে এই প্রত্যাশার সঙ্গে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের ভারসাম্য রক্ষা করে।