অবশেষে ছয় মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় সরকারের ৮ম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) গঠনের বিষয়ে কার্যত কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের মধ্যে উদ্বেগ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ৮ম বেতন কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের বেতন, পেনশন এবং ভাতার কাঠামো নতুন করে নির্ধারণ করবে। এর ফলে সরাসরি উপকৃত হবেন প্রায় ৫০ লাখ কর্মচারী এবং ৬৫ লাখের বেশি পেনশনভোগী। কিন্তু ঘোষণা হওয়ার পর এতদিন কেটে গেলেও সরকার এখনও পর্যন্ত গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি, কমিশনের চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণা হয়নি এবং ‘টার্মস অফ রেফারেন্স’ (ToR) অর্থাৎ শর্তাবলীও চূড়ান্ত করা হয়নি।
ফলে কমিশনের কার্যকর হওয়ার জন্য যে ধাপগুলো দরকার, তা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। এমনকি ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করার যে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
তুলনায়, ৭ম বেতন কমিশন গঠিত হয়েছিল ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে এবং তার ToR ঘোষণা করা হয়েছিল ১৫৬ দিনের মধ্যে, অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে। সেই প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, ৮ম কমিশনের ঘোষণা হয়েছে ১৬ জানুয়ারি ২০২৫-এ, এবং ইতিমধ্যেই ১৬০ দিনেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, তবুও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
এই দেরি নিয়ে কেন্দ্রীয় কর্মচারী ইউনিয়নগুলোর মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। জাতীয় পরিষদ (JCM)-এর সচিব শিব গোপাল মিশ্র একটি চিঠির মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে এই বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কর্মচারী পক্ষ ইতিমধ্যেই তাদের প্রস্তাবনা সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল এবং কমিশন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আলোচনাও সম্পন্ন হয়েছিল। তবুও, প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সদর্থক সাড়া মেলেনি।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, কমিশন গঠনের কাজ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সম্পূর্ণ করা উচিত ছিল যাতে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করা সম্ভব হয়। এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি ঘোষণা বা পরিষ্কার রোডম্যাপ না থাকায়, কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
৮ম বেতন কমিশনকে ঘিরে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে মূল্যবৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে কর্মচারীরা সরকারের কাছে বেতন সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সরকারও একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষায় শীঘ্রই নতুন বেতন কমিশন গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি রূপ পায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন বেতন কমিশনের মাধ্যমে সরকার শুধু কর্মচারীদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে না, বরং সরকারের সামগ্রিক ব্যয়ের ওপরও এর একটি বড় প্রভাব থাকবে। এই কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হলে, সরকারের বার্ষিক বেতন ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। তাই এই সিদ্ধান্তটি অর্থনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, কর্মচারীদের একাংশের মতে, বেতন কমিশনের ঘোষণা এবং বাস্তবায়নের মধ্যে দীর্ঘসূত্রিতা সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। সরকারের এমন বিলম্বী মনোভাবের ফলে মাঠপর্যায়ের কর্মীরা নতুন বেতন কাঠামোর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং এর প্রভাব তাদের মনোবলের ওপরও পড়ছে।
কর্মচারী ইউনিয়নগুলোর তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে, দ্রুত গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য সদস্যদের নাম ঘোষণা করতে হবে। সেইসাথে ToR চূড়ান্ত করে কমিশনের কাজ শুরু করতে হবে। না হলে আগামী দিনে বড় আকারের আন্দোলনের পথে নামতে হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
অতীতে দেখা গেছে, প্রতিটি বেতন কমিশন গঠনের পর একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই সরকার পরবর্তী বেতন কাঠামো ও ভাতা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বর্তমানে ৮ম কমিশনের কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় রিপোর্ট দেওয়ার সময়সীমা এবং তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ৮ম বেতন কমিশনের দেরি কেন্দ্রীয় কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে একধরনের হতাশা তৈরি করেছে। তারা চাচ্ছেন সরকার দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখুক এবং একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করুক। অন্যথায়, বেতন ও ভাতার কাঠামো নিয়ে যে আশা তৈরি হয়েছে, তা হতাশায় পরিণত হবে। এখন দেখার বিষয়, সরকার কত দ্রুত এই বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দেয় এবং কত দ্রুত কমিশনের কাজ শুরু হয়। দেশের লক্ষ লক্ষ কর্মচারী ও তাদের পরিবার সেই দিনের অপেক্ষায়।