UNESCO: ‘শিক্ষা দুর্নীতির স্বর্গ’ বাংলা থেকেই বিশ্ব সেরা শিক্ষক দৌড়ে দীপনারায়ণ

নেই কোনও ঘর, নেই মাথার উপরের ছাদ। রাস্তার উপর খোলা আকাশের নিচে চলছে পড়াশোনা। এমনই এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন দীপনারায়ণ। ইউনেস্কোর (UNESCO) গ্লোবাল টিচার…

নেই কোনও ঘর, নেই মাথার উপরের ছাদ। রাস্তার উপর খোলা আকাশের নিচে চলছে পড়াশোনা। এমনই এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন দীপনারায়ণ। ইউনেস্কোর (UNESCO) গ্লোবাল টিচার প্রাইজ ২০২৩ পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। শিক্ষা বিভাগের দুর্নীতির স্বর্গ পশ্চিমবঙ্গ থেকেই বিশ্ব সেরা শিক্ষক তালিকায় তাঁর নাম থাকল।

প্রত্যন্ত গ্রামের দীপনারায়ণ সেরার শিরোপা পাবেন কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয় তবে, আগামী ৮ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর ৪২ তম সাধারণ সভায় উপস্থিত থাকছেন দীপনারায়ণ। সেদিনই দুনিয়ার সেরা শিক্ষককে বেছে নেবে ইউনেস্কো।

পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়ার ননডি গ্রামের এই বাসিন্দা ২০১০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পান। নিজের জীবনের কঠিন শৈশবের দিনগুলো মনে পড়ে তাঁর। এরপরেই শুরু হয় শিক্ষাদানের লড়াই। দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বই-খাতা কিনে দেওয়ার সঙ্গে তাদের পড়ানোও শুরু করেন দীপনারায়ণ।

ছোটবেলা থেকে পাঁচ ভাই-বোনের নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসার। বাবা ছিলেন দিনমজুর। পড়ার বই-খাতা কেনার সামর্থ্য না থাকায় অন্যের থেকে চেয়ে চালাতেন পড়াশুনো। এমবিএতে ভর্তি হয়েও টাকার অভাবে পড়া ছেড়ে দেন। এই অভাবের তাড়নায় দীপনারায়ণ বুঝতে পারেন, যে ভাবে হোক একটি চাকরি জোটাতে হবে তাঁকে। জামুড়িয়ার জবা তিলকা মাঝি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে দীপনারায়ণ দেখেন, ছাত্র-ছাত্রীদের বেশিরভাগই আদীবাসী। তারা স্কুলে আসলেও পড়াশোনায় একেবারে মনোযোগী নয়। হাল না ছেড়ে ছুটির দিনে স্কুলের বাইরে পড়ানো শুরু করেন দীপনারায়ণ।

কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হয় করোনা অতিমারীর সময়ে। যখন তিনি চরম সমস্যার মুখে পড়েন। দীপনারায়ণ বুঝতে পারেন, এই সব পড়ুয়াদের কাছে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট দূর গ্রহের ব্যাপার। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, স্কুলটাকেই তিনি তুলে নিয়ে যাবেন নিজের বাড়িতে। বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামে, নিম্নবিত্ত পাড়াগুলোর মাটির বাড়ির দেওয়ালে কালো রং দিয়ে তৈরি করলেন প্রচুর ব্ল্যাকবোর্ড। তার সামনে পড়ুয়াদের বসিয়ে শুরু করলেন পড়ানো। একইসঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমাদেরও শিক্ষিত করার কাজ শুরু করলেন তিনি।

ক্রমশ গ্রামগুলোয় পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। যাঁরা কখনও স্কুলের গণ্ডির ধারে-কাছে যাননি, তাঁরাও চলে এলেন মাটির দেওয়ালের ব্ল্যাকবোর্ডে ক্লাস করতে। ধীরে ধীরে এই কাজের কথা প্রচারিত হল। ঝাড়খণ্ডের দু’টি এবং পশ্চিম বর্ধমান সমেত এ রাজ্যের চারটি জেলার কিছু অংশে শুরু হলো এই পদ্ধতিতে শিক্ষাদান। দীপনারায়ণ জানিয়েছে , ‘পড়াতে পড়াতেই একদিন স্লোগান ঠিক করে ফেলি। যেখানেই দেওয়াল আছে, সেখানেই রাস্তা আছে। অর্থাৎ দেওয়াল প্রতিবন্ধকতা নয়, ইচ্ছা থাকলে দেওয়ালের মাধ্যমেই আমরা সবাইকে শিক্ষিত করে তুলতে পারি।’

দীপনারায়ণ আরো জানিয়েছেন, ১৩০টি দেশের মধ্যে ইউনেস্কোর সেরা শিক্ষকের তালিকায় তাঁর মতো ফাইনাল রাউন্ডে মনোনয়ন পেয়েছেন মোট ১০ জন। সেরা শিক্ষকের পুরস্কারমূল্য চোখ কপালে তোলার মতোই। এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৮ নভেম্বর ইউনেস্কোর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে ৫ তারিখ ফ্রান্সে পৌঁছবেন দীপনারায়ণ। তাঁর এই স্বীকৃতিকে অভিনন্দন জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা দফতর।

দীপনারায়ণ বলেন, ‘পিছিয়ে পড়া অনুন্নত এলাকার শিশুদের শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিষ্ঠিত লন্ডনের ভারকে ফাউন্ডেশন, দুবাই কেয়ার্স এবং সর্বোপরি ইউনেস্কোর যৌথ উদ্যোগে প্রতি বছর এই পুরস্কার দেওয়া হয়। গ্লোবাল টিচার প্রাইজ শিক্ষকতায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ পুরস্কার। এক মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার মূল্য যৌথ ভাবে এই সংস্থাগুলোই দেয়।’ এই সম্মানের জন্য বাছাই ১০ জনের মধ্যে ভারতের দীপনারায়ণ ছাড়া রয়েছেন আমেরিকা, ইউক্রেন, কানাডা, ঘানা, চিলি, ইউকে, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তানের শিক্ষকরা। দীপনারায়ণ বলেন, ‘১৩০টি দেশের মধ্যে সেরা দশের তালিকায় নির্বাচিত হওয়া কম গৌরবের নয়। এটা আমাদের দেশেরও গৌরব বলে মনে করি।’