আজ বিকেলে নবান্ন বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ডিভিসিকে দোষারোপ করে বলেছিলেন তারা কেন প্রত্যেকবারের মত জল ছাড়ে (Tathagata)। তাতে বাংলার মানুষের গড় ভাসে। বানভাসি বাংলার প্রত্যেক বছরের ছবি। আর এই ছবি বর্ণনা করতে গিয়ে মমতা কেন্দ্রের এবং ডিভিসিকে দোষারোপ করেছেন। এই বৈঠকের শেষে রাজনৈতিক মহলে ওঠে সমালোচনার ঝড়। বাদ যাননি বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা তথাগত রায়।
বিজেপি নেতা তথাগত রায় তার এক্স হ্যান্ডেলের পোস্টে তিনি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে ‘কুমিরছানা’র সঙ্গে তুলনা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতির উপর প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, “উজানে, ঝাড়খণ্ডে বেশি বৃষ্টি হলে ডিভিসি জল ছাড়তে বাধ্য, বাধ্য, বাধ্য।
মমতা এত বোকা নন যে এই সরল কথাটা বুঝবেন না। তা সত্ত্বেও অম্লানবদনে জল ছাড়ার জন্য ডিভিসিকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন। আর ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ নামক এক বিখ্যাত কুমীরছানা দেখিয়ে যাচ্ছেন!” তথাগত রায় আরও প্রশ্ন তুলেছেন, “আর কতদিন ধোঁকা খাবেন নিম্ন দামোদর উপত্যকার মানুষ?”
এবং উত্তর দিয়েছেন, “যতদিন মমতা মসনদে থাকবেন!” তথাগত তার পোস্টের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন মমতা বহুদিন ধরে এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে মানুষের সঙ্গে তঞ্চকতা করে আসছেন আর তার সাথে দোষ দিচ্ছেন ডিভিসিকে। তথাগতের প্রশ্ন, এই তঞ্চকতা আর কতদিন চলবে ?
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান
দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতিঘাটাল মাস্টার প্ল্যান পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার বন্যা সমস্যা সমাধানের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এই এলাকায় প্রতি বছর বর্ষায় শিলাবতী, কেলেঘাই, কপালেশ্বরী এবং রূপনারায়ণ নদীর জলস্ফীতির কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, চাষের জমি জলের তলায় চলে যায়, এবং লক্ষাধিক মানুষ গৃহবন্দি হন।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৮৩ সালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের শিলান্যাস হয়েছিল। তবে, ৪০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৪ সালে বিস্তারিত প্রকল্প প্রতিবেদন (ডিপিআর) কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমা পড়ে, এবং ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ছাড়পত্র মেলে। তবুও, প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে বিতর্ক থামছে না।
রাজ্য সরকারের উদ্যোগ ও মমতার প্রতিশ্রুতিমুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তববায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হুগলির আরামবাগে এক সভায় তিনি ঘোষণা করেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা ছাড়াই রাজ্য নিজস্ব তহবিলে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করবে।
তিনি বলেন, “ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে মোট ১৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এর মধ্যে ৫০০ কোটি ইতিমধ্যেই বরাদ্দ করা হয়েছে, এবং ৩৪০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে।” ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে এটি সম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে।
ঘাটালের সাংসদ দেব (দীপক অধিকারী) এই প্রকল্পের জন্য সরব হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান আমার এবং ঘাটালবাসীর ৭০ বছরের স্বপ্ন। রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে এটি সত্যি হতে চলেছে।” তবে, তিনি স্বীকার করেছেন যে এই প্রকল্প তিন মাসে সম্পূর্ণ হওয়ার মতো নয়, এবং এর জন্য সময় প্রয়োজন।
ভাঙা হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটে, উদ্বেগ মমতার আবেদন বাংলাদেশকে
ডিভিসির উপর দোষারোপ
তথাগত রায়ের সমালোচনাতথাগত রায় তাঁর এক্স পোস্টে দাবি করেছেন, ঝাড়খণ্ডে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) জল ছাড়তে বাধ্য হয়, যা পশ্চিমবঙ্গের নিম্ন দামোদর উপত্যকায় বন্যার কারণ হয়। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে বলেছেন, তিনি এই সরল সত্য বোঝেন, কিন্তু তবুও ডিভিসিকে দোষারোপ করেন এবং ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে ‘কুমিরছানা’ হিসেবে ব্যবহার করে জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছেন।
তাঁর মতে, এই প্রকল্প নিয়ে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, বাস্তবায়নের অগ্রগতি নগণ্য, এবং নিম্ন দামোদর উপত্যকার মানুষ এই ‘ধোঁকা’র শিকার হচ্ছেন।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক্স-এ দাবি করেছিলেন, “ডিভিসির ছাড়া বিপুল পরিমাণ জলে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যাকবলিত। পরিকল্পিতভাবে বাংলায় ম্যানমেড বন্যা করা হচ্ছে।” তিনি ডিভিসির সঙ্গে কথা বলার কথা উল্লেখ করেছেন, তবে সমাধানের কোনো স্পষ্ট পথ দেখাননি।
জমি অধিগ্রহণ ও স্থানীয় প্রতিবাদঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক চলছে। দাসপুরে চন্দ্রেশ্বর খাল খননের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকরা প্রতিবাদে নেমেছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এই খাল খননের ফলে তাঁদের চাষের জমি নষ্ট হবে এবং ঘাটালের জলাবদ্ধতা সমাধানের জন্য দাসপুর প্লাবিত হবে।
চন্দ্রেশ্বর নদী খনন প্রতিবাদী কমিটির সভাপতি রবীন্দ্রনাথ বেরা বলেছেন, “আমরা জমি দেব না।” এই প্রতিবাদের মুখে সেচ দপ্তর লিফলেট বিতরণ করে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, জমির জন্য বাজারমূল্যের আড়াই গুণ দাম দেওয়া হবে।
অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ
রাজ্য সরকার জানিয়েছে, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই এগোচ্ছে। শিলাবতী নদীর পাড়ে গার্ডওয়াল নির্মাণ, রূপনারায়ণ ও কংসাবতী নদীর সংস্কার, এবং পাম্প হাউস তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিলান্যাস হয়েছে, এবং ২০২৮ সালের মার্চের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। তবে, কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলায় রাজ্যের জমা দেওয়া রিপোর্টে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি, এবং বলেছেন, “আগামী বর্ষার আগে কিছু তো করুন।”
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে রাজনৈতিক তরজা এবং জনগণের প্রত্যাশা একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দেবের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, তথাগত রায়ের মতো সমালোচকরা এটিকে ‘কুমিরছানা’ হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণের প্রতি ‘ধোঁকা’র অভিযোগ তুলছেন।
নিম্ন দামোদর উপত্যকার মানুষের জন্য বন্যা সমস্যার সমাধান এখনও সুদূর। প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রের সমন্বয়, স্থানীয়দের সমর্থন এবং স্বচ্ছ পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি।