আজকের দিনে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে একটি নতুন সকাল দেখা দিয়েছে। সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ব্রাহ্মোসের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে প্রকাশিত একটি পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, ইজিপ্ট, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং ওমান—এই ১৬টি দেশ ভারতের ব্রাহ্মোস মিসাইল কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই তথ্যটি শুধুমাত্র একটি সাধারণ খবর নয়, বরং এটি ভারতের প্রতিরক্ষা রফতানি খাতে একটি বিপ্লবী পরিবর্তনের প্রতীক।
ব্রাহ্মোস মিসাইল (BrahMos Missile) যা ভারতের রক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (DRDO) এবং রাশিয়ার NPO Mashinostroyenia-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি, এটি তিন গুণে বেগে শব্দের (Mach 2.8-3.0) চলার ক্ষমতা রাখে। ২০১৬ সালে ভারত মিসাইল টেকনোলজি নিয়ন্ত্রণ শাসনমূলক (MTCR)-এ যোগদান করার পর থেকে এর পরিসীমা ৪৫০ থেকে ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে হাইপারসনিক সংস্করণ (BrahMos-II) যা ১১,০০০ কিলোমিটার/ঘণ্টা বেগে ছুটবে, তা পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রযুক্তির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভারতের দিকে তাকিয়েছে, বিশেষ করে এমন দেশগুলো যারা ভূ-রাজনৈতিক চাপের মুখোমুখি। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ চিন সমুদ্রে চিনের প্রভাব বাড়ার কারণে ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো এই অস্ত্রে আগ্রহী।
প্রতিরক্ষা রফতানিতে ভারতের অগ্রগতি
ভারত সরকার ২০১৮ সালে “মেক ইন ইন্ডিয়া” উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রতিরক্ষা উৎপাদন নীতি প্রবর্তন করে, যার লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি বছর ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা রফতানি। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে ভারতের প্রতিরক্ষা রফতানি মাত্র ৬৮৬ কোটি টাকা ছিল, সেখানে আজ এটি ৭০০% বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪৫,০০০ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। ফিলিপাইনের সঙ্গে ২০২২ সালে স্বাক্ষরিত ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি এবং এর দ্বিতীয় ব্যাচ সমুদ্রপথে রফতানি এই সফলতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এই চুক্তির অংশ হিসেবে ফিলিপাইনের নৌবাহিনী এখন ব্রাহ্মোস মিসাইল ব্যবহারের মাধ্যমে তার সীমানা রক্ষায় কার্যকর হয়ে উঠেছে।
ইন্দোনেশিয়া সম্প্রতি ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের ব্রাহ্মোস চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে, যা ভারতের জন্য আরও একটি বড় সুযোগ। উপরন্তু, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোও এই মিসাইল কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই সবকিছু একসঙ্গে ভারতকে একটি উদীয়মান প্রতিরক্ষা শক্তি হিসেবে স্থাপন করছে, যা কেবল সামরিক শক্তি নয়, বরং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার দ্বারও খুলে দিচ্ছে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ব্রাহ্মোসের জন্য এতো বড় আগ্রহের পেছনে ভূ-রাজনৈতিক কারণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চিনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ এবং দক্ষিণ চিন সমুদ্রে তার প্রসারণবাদী নীতির কারণে এশিয়ার অনেক দেশ ভারতের কাছে সহযোগিতা খুঁজছে। ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো চিনের সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে একটি সংযোজক শক্তি হিসেবে ভারতের ব্রাহ্মোসকে দেখছে। অন্যদিকে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যেমন ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা এই মিসাইলের মাধ্যমে তাদের সামরিক ক্ষমতা বাড়াতে চায়।
কিন্তু এই বিষয়ে সমালোচনাও রয়েছে। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, কাতারের মতো দেশের জন্য ব্রাহ্মোস রফতানি সামরিক ভারসাম্যের ক্ষতি করতে পারে। তবে, ভারত সরকার এই চুক্তিগুলোতে সাবধানী হয়ে কাজ করছে এবং প্রতিটি রফতানি সিদ্ধান্ত গভীর ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নিচ্ছে।
ব্রাহ্মোস-২-এর হাইপারসনিক সংস্করণ যদি সফল হয়, তবে ভারতের প্রতিরক্ষা রফতানি আরও বেশি উচ্চতায় উঠবে। এই মিসাইল চিনের DF-17-এর তুলনায় বেশি কার্যক্ষম হতে পারে, যা ভারতকে বিশ্বের শীর্ষ প্রতিরক্ষা রফতানিকারক দেশগুলোর তালিকায় নিয়ে যাবে। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং চাকরির সৃষ্টি বৃদ্ধি পাবে, যা “অপারেশন সিঁদুরে লক্ষ্মীলাভ”-এর মতো একটি অর্থনৈতিক স্বপ্নকে সফল করবে।
এই মুহূর্তে, ভারতের জন্য এটি গর্বের বিষয় যে, তার প্রযুক্তি এবং কৌশল বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তবে, এই সুযোগটি কাজে লাগাতে ভারতকে আরও বেশি গবেষণা, উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দরকার। যদি এটি সম্পন্ন হয়, তবে ভারত শুধুমাত্র একটি সামরিক শক্তি হিসেবে নয়, একটি অর্থনৈতিক মহাশক্তি হিসেবেও পরিচিত হবে।