ভারতীয় ফুটবল গত এক দশকে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে। এই সময়ে ভারতীয় খেলোয়াড়দের মার্কেট ভ্যালু উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তাদের মাঠের পারফরম্যান্স এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রতিফলন। ট্রান্সফার মার্কেটে (Transfer market) ভারতীয় ফুটবলারদের মূল্যায়ন এখন শুধুমাত্র তাদের খেলার দক্ষতার উপর নয়, বরং তাদের ব্র্যান্ড মূল্য এবং সম্ভাবনার উপরও নির্ভর করে। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৪-২৫ মরসুমে ট্রান্সফার মার্কেটে শীর্ষ ৫ মূল্যবান ভারতীয় ফুটবলার, তাদের পারফরম্যান্স, এবং তাদের মূল্যায়নের কারণ নিয়ে আলোচনা করব।
১. সুনীল ছেত্রী (বেঙ্গালুরু এফসি)
মার্কেট ভ্যালু: প্রায় ১.৫ কোটি টাকা
ভারতীয় ফুটবলের পোস্টার বয় সুনীল ছেত্রী এখনও ট্রান্সফার মার্কেটে শীর্ষে রয়েছেন, যদিও তাঁর বয়স এবং মার্কেট ভ্যালু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা কমেছে। ৪০ বছর বয়সেও ছেত্রী বেঙ্গালুরু এফসি এবং জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে চলেছেন। ১১৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৭২টি গোল করে তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা সক্রিয় ফুটবলার। ২০২৪-২৫ আইএসএল মরসুমে তিনি ১৪টি ম্যাচে ৫টি গোল এবং ২টি অ্যাসিস্ট করেছেন। তাঁর নেতৃত্ব, অভিজ্ঞতা, এবং ব্র্যান্ড মূল্য তাঁকে ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড় করে রেখেছে। তবে, বয়সের কারণে তাঁর মার্কেট ভ্যালু কিছুটা কমলেও, তাঁর প্রভাব এখনও অপরিসীম।
২. গুরপ্রীত সিং সান্ধু (বেঙ্গালুরু এফসি)
মার্কেট ভ্যালু: প্রায় ১.২ কোটি টাকা
ভারতীয় জাতীয় দলের প্রথম পছন্দের গোলকিপার গুরপ্রীত সিং সান্ধু ট্রান্সফার মার্কেটে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। পাঞ্জাবের এই গোলকিপার ২০১৪ সালে নরওয়ের স্টাবেক ক্লাবে খেলে ইউইএফএ ইউরোপা লিগে অংশগ্রহণকারী প্রথম ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে ইতিহাস গড়েছিলেন। বেঙ্গালুরু এফসির হয়ে তিনি ৭০টি ম্যাচ খেলেছেন এবং টানা দুইবার আইএসএল গোল্ডেন গ্লাভ অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। ২০২৪-২৫ মরসুমে তিনি ১৫টি ম্যাচে ৬৮% সেভ রেট এবং ৫টি ক্লিন শিট অর্জন করেছেন। তাঁর আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাঁর মার্কেট ভ্যালু বাড়িয়েছে।
৩. লালিয়ানজুয়ালা ছাংতে (মুম্বাই সিটি এফসি)
মার্কেট ভ্যালু: প্রায় ১ কোটি টাকা
মিজোরামের এই তরুণ উইঙ্গার লালিয়ানজুয়ালা ছাংতে মুম্বাই সিটি এফসির হয়ে ২০২৪-২৫ মরসুমে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন। ২০২২ সালের ডুরান্ড কাপে তিনি ৭টি গোল এবং ৩টি অ্যাসিস্ট করে মুম্বাই সিটির হয়ে ১০টি গোল-কন্ট্রিবিউশন রেকর্ড করেছিলেন। এই মরসুমে তিনি ১৬টি ম্যাচে ৪টি গোল এবং ৫টি অ্যাসিস্ট করেছেন। তাঁর গতি, ড্রিবলিং, এবং গোলের সামনে নির্ভুলতা তাঁকে ভারতীয় ফুটবলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মুম্বাই সিটি এফসির সাথে তাঁর স্থায়ী চুক্তি এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাঁর মার্কেট ভ্যালু বাড়িয়েছে।
৪. অনিরুদ্ধ থাপা (মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট)
মার্কেট ভ্যালু: প্রায় ৮০ লাখ টাকা
মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের মিডফিল্ডের মেরুদণ্ড অনিরুদ্ধ থাপা ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম প্রতিভাবান খেলোয়াড়। ২০২৪-২৫ মরসুমে তিনি মোহনবাগানের হয়ে ১৫টি ম্যাচে ২টি গোল এবং ৩টি অ্যাসিস্ট করেছেন। তাঁর পাসের নির্ভুলতা, খেলার নিয়ন্ত্রণ, এবং মাঠের মাঝখানে নেতৃত্ব তাঁকে দলের অপরিহার্য অংশ করে তুলেছে। ২০২৮ সাল পর্যন্ত মোহনবাগানের সাথে তাঁর চুক্তি রয়েছে, এবং মুম্বাই সিটি এফসির মতো ক্লাব তাঁকে দলে ভেড়ানোর জন্য আগ্রহ দেখালেও, মোহনবাগান তাঁকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। থাপার ধারাবাহিক পারফরম্যান্স এবং তরুণ বয়স তাঁর মার্কেট ভ্যালু বাড়িয়েছে।
৫. আকাশ মিশ্র (হায়দরাবাদ এফসি)
মার্কেট ভ্যালু: প্রায় ৭৫ লাখ টাকা
হায়দরাবাদ এফসির তরুণ ডিফেন্ডার আকাশ মিশ্র ২০২১-২২ আইএসএল মরসুমে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০২৪-২৫ মরসুমে তিনি ১৪টি ম্যাচে ৮৫% পাস নির্ভুলতা এবং ৪টি ক্লিন শিটে অবদান রেখেছেন। তাঁর গতি, ডিফেন্সিভ দক্ষতা, এবং আক্রমণে অংশগ্রহণ তাঁকে ভারতীয় ফুটবলের উদীয়মান তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর তরুণ বয়স এবং সম্ভাবনা তাঁর মার্কেট ভ্যালু বাড়িয়েছে, এবং হায়দরাবাদ এফসি তাঁকে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে আবদ্ধ করেছে।
কেন এই খেলোয়াড়রা মূল্যবান?
এই পাঁচজন খেলোয়াড়ের মার্কেট ভ্যালু তাদের মাঠের পারফরম্যান্স, অভিজ্ঞতা, এবং ব্র্যান্ড মূল্যের সমন্বয়ে নির্ধারিত হয়েছে। সুনীল ছেত্রী এবং গুরপ্রীত সিং সান্ধুর মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং ধারাবাহিকতার জন্য মূল্যবান, যখন ছাংতে, থাপা, এবং মিশ্রের মতো তরুণরা তাদের সম্ভাবনা এবং বর্তমান পারফরম্যান্সের জন্য ক্লাবগুলোর নজরে রয়েছেন। আইএসএল-এর মতো লিগ এবং ডুরান্ড কাপ, সুপার কাপের মতো টুর্নামেন্টে তাদের পারফরম্যান্স তাদের মূল্য বাড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের ২০২৪-২৫ মরসুমে লিগ শিল্ড এবং কাপ জয়ে থাপার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রান্সফার মার্কেটে ভারতীয় ফুটবল
আইএসএল-এর আগমনের পর থেকে ভারতীয় ফুটবলারদের মার্কেট ভ্যালু ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মোহনবাগান, মুম্বাই সিটি এফসি, এবং বেঙ্গালুরু এফসির মতো ক্লাবগুলোর আর্থিক সক্ষমতা এবং বিদেশি মালিকানা (যেমন মুম্বাই সিটি এফসির সিটি ফুটবল গ্রুপ) ভারতীয় খেলোয়াড়দের মূল্য বাড়িয়েছে। তবে, ট্রান্সফার মার্কেটে ভারতীয় খেলোয়াড়দের মূল্য এখনও বিশ্বের শীর্ষ লিগের তুলনায় কম। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের শীর্ষ ফুটবলারদের মার্কেট ভ্যালু ১০০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি হলেও, ভারতীয় খেলোয়াড়দের মূল্য ১-২ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, এবং তরুণ খেলোয়াড়রা যেমন ছাংতে এবং মিশ্র তাদের সম্ভাবনার মাধ্যমে ট্রান্সফার মার্কেটে আরও উঁচুতে উঠতে পারেন। আইএসএল-এর পাশাপাশি এএফসি প্রতিযোগিতায় ভারতীয় ক্লাবগুলোর অংশগ্রহণ ভারতীয় খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রকাশের সুযোগ করে দেবে। এছাড়া, যুব উন্নয়ন প্রোগ্রাম এবং আইএসএল-এর মতো লিগের মাধ্যমে নতুন প্রতিভার উত্থান ভারতীয় ফুটবলের মার্কেট ভ্যালুকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
ট্রান্সফার মার্কেটে সুনীল ছেত্রী, গুরপ্রীত সিং সান্ধু, লালিয়ানজুয়ালা ছাংতে, অনিরুদ্ধ থাপা, এবং আকাশ মিশ্র ভারতীয় ফুটবলের শীর্ষ মূল্যবান খেলোয়াড়। তাদের পারফরম্যান্স, অভিজ্ঞতা, এবং সম্ভাবনা তাদের মার্কেট ভ্যালু নির্ধারণ করেছে। আইএসএল এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতায় তাদের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির প্রমাণ। ভক্তদের জন্য এই খেলোয়াড়রা শুধুমাত্র মাঠের তারকা নয়, বরং ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যতের প্রতীক। আগামী বছরগুলোতে আরও তরুণ প্রতিভার উত্থানের সাথে ভারতীয় ফুটবল ট্রান্সফার মার্কেটে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।