ছোটবেলা থেকেই কুস্তির আখড়া ছিল তার স্বপ্নের জায়গা। প্রপিতামহ চৌধরি হাজারি লালের দঙ্গল কাঁপানো গল্প শুনে বড় হওয়া হরিয়ানার ঝাজ্জরের খানপুর কালান গ্রামের মেয়ে তপস্যা গেহলট (Tapasya Gahlawat)। আজ বিশ্বের কুস্তি মঞ্চে ভারতের নাম উজ্জ্বল করলেন তিনি। বুলগেরিয়ার (Bulgaria) সামাকভে (Samokov) অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্ব কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপে (Wrestling Junior World Championships) ৫৭ কেজি বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাবা পরেশ গেহলটের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন সফল করলেন তিনি।
তপস্যার এই জয়ের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প। শুধু রিংয়ের লড়াই নয়, সমাজের কটাক্ষ, বৈষম্য আর সীমিত পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরেই এসেছে এই সাফল্য। বুধবার ফাইনালে নরওয়ের ফেলিসিতাস দোমাজেভাকে ৫-২ ব্যবধানে হারিয়ে ভারতের হয়ে প্রথম সোনার পদক জেতেন তপস্যা। কিন্তু তার থেকেও বড় লড়াই ছিল সেমিফাইনালে। প্রতিপক্ষ ছিলেন জাপানের অপরাজিত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সোওয়াকা উচিদা। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে ৪-৩ ব্যবধানে জয় নিশ্চিত করে চমকে দেন তপস্যা।
তপস্যার বাবা পরমেশ গেহলট নিজেও জাতীয় স্তরের কুস্তিগির ছিলেন। কিন্তু চোটের কারণে কেরিয়ার থেমে যায়। সেই অপূর্ণ স্বপ্নই তিনি মেয়ের মাধ্যমে পূরণ করতে চেয়েছিলেন। অথচ মেয়ের জন্মের পর সমাজের একাংশ থেকে তাঁকে শুনতে হয়েছিল কটূক্তি। ২০০৬ সালে, বিয়ের ১১ মাস পর কন্যাসন্তান জন্মালে অনেকেই তাঁকে বলেন, “মেয়ে বড় হয়ে কী করবে?” সেসময় পরমেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, “মেয়ে হোক কিংবা ছেলে, যে কেউ দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে।” আজ তাঁর সেই বিশ্বাসই সত্যি হয়েছে।
২০১৬ সালে স্থানীয় একটি অ্যাকাডেমিতে কুস্তি শেখা শুরু করেন তপস্যা। কিন্তু সেখানকার পরিকাঠামো সন্তোষজনক ছিল না। তখন পরমেশ মেয়েকে নিয়ে যান সোনিপতের কুলবীর রানার আখড়ায়। স্ত্রী নবীনা শুরুতে মেয়েকে দূরে পাঠাতে আপত্তি করলেও পরে স্বামীর সিদ্ধান্ত মেনে নেন। তবে পরিবার-পরিজন থেকে আলাদা করে মেয়েকে কুস্তি শেখানোর সিদ্ধান্তে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল পরমেশকে।
তবে তপস্যার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম এবং কোচ কুলবীর রানার সহানুভূতিশীল প্রশিক্ষণ একে একে সব বাধা দূর করে দেয়। পরমেশ বলেন, “তপস্যাকে নিয়ে কোচ কুলবীর সবসময় বলতেন, ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করতেন। তিনি ওকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।”
আজকের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কুস্তির প্রতি ভালোবাসা। পরমেশ জানান, “আমার ঠাকুরদা হাজারি লাল গ্রামে বিখ্যাত কুস্তিগির ছিলেন। তিনি আমাদের কুস্তির নানা কৌশল শেখাতেন। তাঁর দেখানো পথেই আমি কুস্তি শুরু করি। তবে ভাগ্য সঙ্গ দেয়নি। তখনই ঠিক করেছিলাম, মেয়েকে তৈরি করব।”
তপস্যা আজ শুধু বিশ্বচ্যাম্পিয়নই নন, তিনি নারীশক্তির এক জীবন্ত প্রতীক। সমাজের কটাক্ষ, লিঙ্গবৈষম্য, আর প্রতিকূলতা পেরিয়ে উঠে আসা এই মেয়েটি আজ ভারতের গর্ব। অনূর্ধ্ব-২০ বিভাগে এশিয়া সেরা হওয়ার পর এবার তাঁর লক্ষ্য সিনিয়র স্তরে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করা। আর সেই লক্ষ্যে এগিয়ে চলার জন্য প্রস্তুত তপস্যা।